রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও প্রশাসনিক ব্যর্থতায় শ্রমিকসহ ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় বাসাবাড়ি ও ক্ষুদ্র ব্যবসা খাত |
গত জুলাইয়ে সরকারবিরোধী দাঙ্গার পর চলমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এখনো কমেনি। অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যর্থতা, দায়িত্বশীলদের অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনাসহ নামিদামি প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকপক্ষের ওপর মব সন্ত্রাস, মামলা, গ্রেপ্তারের মাধ্যমে দেশের পুরো পোশাক খাতের ওপর নেমে এসেছে গাঢ় অন্ধকার। সারাদেশে হাজার হাজার কারখানা এখন বন্ধ। ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় বন্ধের উপক্রম। রাজনৈতিক হয়রানির কারণে মালিকপক্ষও ব্যবসা করে দিয়েছেন। অনেকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়ায় আটকে গেছে অর্থ। ফলে শ্রমিকদেরও মজুরি আটকে গেছে।
এমন অবস্থায় দেশের শিল্পাঞ্চল এবং তার আশপাশের এলাকাগুলোতে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যবসাতেও নেমে এসেছে মন্দা। গত ১০ মাসে গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ৪১টি কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। মানবেতর জীবন-যাপন করছেন লক্ষাধিক শ্রমিক। শ্রমিকদের ওপর নির্ভরশীল এলাকার বিভিন্ন ক্ষুদ্র ব্যবসা ও বাসা ভাড়াতেও ধস নেমেছে।
কারখানা মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর তথ্যমতে, বর্তমানে জেলায় নিবন্ধিত কারখানার সংখ্যা ২ হাজার ১৭৬টি, এর মধ্যে পোশাক কারখানা ১ হাজার ১৫৪টি। তবে ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে এ বছরের জুন পর্যন্ত সময়ে অর্ডারের সংকট, কাঁচামালের ঘাটতি ও অর্থনৈতিক অচলাবস্থার কারণে বন্ধ হয়ে গেছে অনেক কারখানা। এতে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন লাখো শ্রমিক। হাজারো শ্রমিক পেশা বদলেছেন, অনেকেই এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন অন্য কোথাও।
শুধু শ্রমিক নয়, বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে শ্রমিক-নির্ভর অর্থনৈতিক কাঠামো। স্থানীয় মুদি দোকান, বাসা ভাড়া, খাবারের হোটেল, সেলুনসহ নানা ক্ষুদ্র ব্যবসায় ধস নেমেছে। মহানগরীর চান্দনা চৌরাস্তা, কোনাবাড়ি, কাশিমপুর, শ্রীপুর ও টঙ্গী এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানার আশপাশের আবাসন ও বাণিজ্যিক স্থাপনাগুলোতে জনশূন্যতা তৈরি হয়েছে।
কারখানা বন্ধের ফলে অনেক শ্রমিক পেশা পরিবর্তনে বাধ্য হয়েছেন। কেউ অটোরিকশা চালাচ্ছেন, কেউ এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন গ্রামে। সন্তানদের পড়ালেখা বন্ধ হয়ে গেছে বহু শ্রমিক পরিবারের।
কাশিমপুরের বেক্সিমকো কারখানার সাবেক কর্মী সুফিয়া খাতুন জানান, “আমি প্রায় ১২ বছর বেক্সিমকোতে কাজ করেছি। ফেব্রুয়ারিতে হঠাৎ কারখানা বন্ধ করে দিলে ৫০ হাজার শ্রমিক চাকরি হারান। আমি পাশের একটি ছোট কারখানায় কাজ পেয়েছি, বেতন কম হলেও টিকে আছি। তবে অধিকাংশ শ্রমিকই কাজ পাচ্ছেন না।”
মুদি দোকানি আবুল হোসেন জানান, “আগে দিনে ৮-১০ হাজার টাকার বেচাবিক্রি হতো, এখন ৩-৪ হাজারে নেমে এসেছে। মানুষ কমে গেছে এলাকায়।”
স্থানীয় একটি সেমিপাকা বাড়ির মালিক ইউনুস মিয়া বলেন, “ভাড়াটিয়া পাওয়াই মুশকিল হয়ে পড়েছে। কেউ থাকছে না, আয় কমে গেছে অনেক। কোনাবাড়ির কেয়া গ্রুপের বেশ কয়েকটি কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কয়েক হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে গেছে। যারা আগে ভাড়া থাকত, তারা চলে গেছে বাসা ছেড়ে।”
স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানাগুলোর মধ্যে রয়েছে –
কাশিমপুরের বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের ১৬টি ইউনিট,
টঙ্গির টিএমএস অ্যাপারেলস,
কোনাবাড়ির পলিকন লিমিটেড, কেয়া গ্রুপ, অ্যাপারেল প্লাস, টিআরজেড, ডেল্টা নিট,
কালিয়াকৈরের চন্দ্রা এলাকার নায়াগ্রা টেক্সটাইল, মাহমুদ জিন্স প্রভৃতি।
শ্রমিক সংগঠনগুলোর দাবি, এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিকদের বকেয়া বেতন এবং পাওনাদি এখনো পরিশোধ করা হয়নি।
গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের গাজীপুর মহানগর সভাপতি শফিউল আলম বলেন, “এক বছর আগে ডার্ড কম্পোজিট বন্ধ হলেও শ্রমিকদের পাওনা এখনো মেটানো হয়নি। মালিকরা দায়িত্ব নিচ্ছেন না, শ্রমিকরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন।”
কারখানা খোলার দাবি ও বকেয়া বেতনের দাবিতে প্রায়ই আন্দোলনে নামছেন বেকার শ্রমিকরা। মহাসড়ক অবরোধের কারণে সৃষ্টি হচ্ছে দীর্ঘ যানজট। দুর্ভোগে পড়ছেন সাধারণ মানুষ।
গাজীপুর শিল্প পুলিশ-২ এর পুলিশ সুপার একেএম জহিরুল ইসলাম জানান, “বিভিন্ন কারণে জেলায় অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। কারখানা খুলে দেওয়া ও বকেয়া বেতনের দাবিতে কর্মহীন শ্রমিকদের অনেকে সড়ক-মহাসড়কে নামে। তাদের আন্দোলন থামাতেও পুলিশের অনেক বেগ পেতে হয়।”
বিশ্লেষকরা বলছেন, গাজীপুরের শিল্প খাত ধসের মুখে। শ্রমিকের পরিবার ছাড়াও প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে স্থানীয় অর্থনীতি ও সমাজজীবনে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক সুশাসন এবং মালিক-শ্রমিক উভয়ের স্বার্থে একটি সমন্বিত উদ্যোগ সময়ের দাবি। নইলে দেশের অন্যতম বৃহৎ উৎপাদনশীল এই অঞ্চলটির চাকা সম্পূর্ণ থেমে যেতে পারে।