২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র ও দেশজুড়ে প্রবল সহিংসতার মাধ্যমে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি ও নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উৎখাতের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয় রাজনৈতিক আন্দোলন। শুরুতে কোটাবিরোধী, তারপর বৈষম্যবিরোধী এবং সবশেষে সরকার উৎখাতের একদফা দাবির নামে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা বিরোধী আন্দোলন পরিচালনা করা হয়।
আন্দোলনের শুরুর দিকের দাবি-দাওয়া শেখ হাসিনার সরকার মেনে নিলেও আন্দোলন বন্ধ হয়নি, বরং সরকারি গুরুত্বর্পূর্ণ স্থাপনা ধ্বংস, অগ্নিসংযোগ, জেল ভেঙে বন্দী জঙ্গিদের বের করে আনা, স্নাইপার দিয়ে গুপ্ত হত্যার মাধ্যমে আন্দোলনকে বেগবান করা, বীভৎস প্রক্রিয়ায় পুলিশ হত্যা ও লাশ বিকৃত করার মতো ঘটনা ঘটিয়ে একটি যুদ্ধপরিস্থিতি তৈরি করা হয় সচেতনভাবে পরিকল্পনামাফিক।
আন্দোলনকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়, যেন সেনা ও বিক্ষোভকারীদের মুখোমুখি অবস্থানে নিয়ে আসা যায়। এরইমাঝে অজ্ঞাত স্থান থেকে গুলি চালিয়ে লাশ ফেলা হয়। এর ফলে আন্দোলনন ভয়াবহ আকার ধারণ করে। রক্তপাত এড়াতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার আলোচনার আহ্বান জানালেও আন্দোলনকারীরা তাতে কর্ণপাত করেনি, বরং উত্তরোত্তর সহিসংতা চালিয়ে যেতে থাকে। একপর্যায়ে পরিস্থিতি মোকাবেলায় অপরাগ হয়ে শেখ হাসিনা দেশত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। সামরিক বাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সুরক্ষা বলয়ে গত বছরের ৫ই আগস্ট তাঁকে দেশের বাইরে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হয়।
ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী-ছাত্রলীগ কর্মী সবুজ আলীকে পিটিয়ে হত্যা করে আন্দোলনকারীরা
এরপরই বিক্ষোভকারীদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে চলে গেছেন চিরতরে। যদিও তেমন কোনো প্রমাণ তারা দেখাতে পারেনি। বেশ কয়েকটি জাল পদত্যাগপত্র হাজির করা হলেও শেখ হাসিনা বিভিন্ন বার্তায় জানিয়েছেন, তিনি কোনো পদত্যাগ পত্রে সাক্ষর করেননি।
৮ই আগস্ট সেনাসমর্থিত ও ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেয়। কিন্তু ৫ই আগস্ট থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়ে সারাদেশে চরম নৈরাজ্য চলতে থাকে। সারাদেশে ৪৬০টিরও বেশি থানা ও পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা-ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুটপাট, নথিপত্র ধ্বংসসাধন, পুলিশ হত্যাসহ নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়। সেইসাথে সারাদেশে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগসহ দলীয় অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের প্রকাশ্যে হত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজ, তাদের বাড়িঘর-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ধূলিস্মাৎ করে দেওয়াসহ সারাদেশে এক ভয়াবহ অরাজকতা চালায় আন্দোলনকারী ও তাদের দোসররা। এমনকি ৮ই আগস্ট ড. ইউনূস ক্ষমতাগ্রহণের পরও তিনি এই সন্ত্রাসী-জঙ্গিদের থামাননি, তাদেরকে নির্বিচারে এসব ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যেতে দিয়েছেন।
পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাজার হাজার অস্ত্র ও বিপুল গোলাবারুদ লুটে নেয় আন্দোলনকারীরা, যাদের নেতৃত্বে ছিল যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াতে ইসলামী ও তাদের গুপ্ত সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রশিবিরের মত স্বাধীনতাবিরোধী সংগঠন। জেল ভেঙে ছেড়ে দেওয়া হয় ২ হাজারেরও বেশি চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও দুর্ধর্ষ প্রশিক্ষিত জঙ্গি। পালিয়ে যায় ফাঁসি ও যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত অসংখ্য খুনি ও সন্ত্রাসী। যাদের বড় অংশ এখনো পলাতক। এছাড়াও ৫ই আগস্টের পর থেকে অন্তর্বর্তী সরকার ও তাদের অংশীদারদের দোসর হিসেবে পরিচিত চিহ্নিত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের জামিন ও প্যারোলে মুক্তি দেওয়া শুরু হয়। ইউনূস সরকার এদের নজরদারিতে রাখবে বলার পরেও তারা রাজধানীসহ সারাদেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে।
এনায়েতপুর থানাতেই ১৩ জন পুলিশ সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করে আন্দোলনকারীরা
আন্দোলনের পুরো সময় জুড়ে নাশকতাকারীদের পূর্ণ সমর্থন ও সহায়তা দিয়ে গেছে বাংলাদেশে জাতিসংঘ কার্যালয়ের কর্মকর্তারা। চলুন দেখা যাক, কীভাবে জাতিসংঘ একটি দেশের নির্বাচিত সরকারের পতনে ভূমিকা রেখেছে।
সরকারবিরোধীদের কর্মকাণ্ড নিয়ে নিশ্চুপ ভূমিকা
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার টুর্ক আন্দোলনের শুরু থেকেই নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। ২৫শে জুলাই প্রকাশিত একটি প্রেস রিলিজে ভলকার টুর্ক আন্দোলনে সহিংসতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন, কোনরকম যাচাই ছাড়াই নিহতের সংখ্যার একটি মনগড়া দাবি করে শেখ হাসিনার সরকারকে নানা উপদেশ-পরামর্শ দেন। মত প্রকাশের স্বাধীনতা, মিছিল মিটিংয়ের স্বাধীনতা নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন ছিলেন তিনি। তবে তিনি তার বক্তব্যে অনেক বিষয় ইচ্ছেকৃতভাবে এড়িয়ে গেছেন, যা সরকারের শক্ত অবস্থানের কারণ ব্যাখ্যা করতে পারে।
পুলিশ হত্যা
যাত্রাবাড়ী এলাকার রায়েরবাগ ওভারব্রিজ থেকে একজন অফ-ডিউটি ট্যুরিস্ট পুলিশের কর্মকর্তা এএসআই মো. মোক্তাদিরকে হত্যা করে ফুটওভার ব্রিজ থেকে ঝুলিয়ে রাখে আন্দোলনকারীরা। লাশ নিতেও দেওয়া হয়নি দীর্ঘ সময় ধরে। তার লাশ নামাতে গেলে মব হামলার আশংকায় পুলিশ ফাঁকা গুলি ছুড়তে বাধ্য হয়। আন্দোলনকারীদের এই নৃশংসতার কথা ভলকার টুর্ক তার প্রেস রিলিজে উল্লেখ করেননি। বরং সরকারের সমালোচনা আন্দোলনকারীদের পূর্ণ সমর্থন দিয়ে গেছেন।
রায়েরবাগে ‘আন্দোলনের আড়ালে’ পুলিশ হত্যা করে ঝুলিয়ে রাখে দুর্বৃত্তরা – বাংলাদেশের আলো
১৯শে জুলাই বনানীতে নির্মমভাবে খুন পুলিশ পরিদর্শক মাসুদ পারভেজ ভুঁইয়া। ঘটনার দিন সন্ধ্যায় বনশ্রীতে বাসার নিচে চা খেতে নামলে হামলার শিকার হন। আন্দোলনকারীরা তাকে ঘিরে ধরে মোবাইল মানিব্যাগ চেক করে পুলিশ পরিচয় পেলে সেখানেই কুপিয়ে ফেলে রেখে যায়। দুই দিন পর তিনি পুলিশ লাইন্স হাসপাতালে মারা যান।
নরসিংদী কারাগারে হামলা
একই দিনে আরো একটি ভয়াবহ ঘটনা ঘটায় আন্দোলনকারী সন্ত্রাসীরা। নরসিংদী জেলার একটি হাই সিকিউরিটি জেলখানায় আক্রমণ করে কয়েদিদের ছাড়িয়ে নিয়ে যায় তারা। পালিয়ে যাওয়া ৮২৬ জন কয়েদীদের মধ্যে ৯ জন ছিল ভয়ঙ্কর জঙ্গি। মূলত এই জঙ্গিদের ছাড়াতেই এই হামলা করা হয় বলে ধারণা বিশ্লেষকদের। আন্দোলনকে সহিংস করা ছাড়া জঙ্গিদের জেল থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার আর কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে? একই সাথে অস্ত্রাগারের বিপুল সংখ্যক অস্ত্র-গোলাবারুদ লুট করে নিয়ে যায় তারা। এই ঘটনার কথাও ভলকার টুর্ক উল্লেখ করেননি।
সেতু ভবন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবনে হামলা
১৮ই জুলাই মহাখালীতে অবস্থিত সেতু ভবনে একযোগে আক্রমণ চালায় আন্দোলনকারীরা। ১২ তলা ভবনের ৬ তলা পর্যন্ত তারা আগুনে ভস্মীভূত করে। মুল্যবান নথিপত্রসহ পুড়ে যায় ৫৫টি গাড়ি, এসি, কম্পিউটার, ইলেকট্রনিক লাইনসহ আসবাবপত্র। বাদ যায়নি ক্যান্টিন, আনসার ক্যাম্প, ড্রাইভারদের বিশ্রামাগার। ভাঙচুর করা হয় ভবনের কাচ, জানালা, নিচতলায় থাকা ডে কেয়ার সেন্টার ও রিসিপশনের আসবাবপত্র। লুটপাট করা হয় কম্পিউটার, টেলিভিশন, ল্যাপটপ ও আসবাবপত্র।
বনানীতে আগুন দেওয়া হয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবন ও কেন্দ্রীয় ডাটা সেন্টারে। সন্ধ্যা ৭টার দিকে আগুন দেয়া হয় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সদর দপ্তরে। আক্রমণকারীদের একটি অংশ অকটেন দিয়ে অগ্নিসংযোগে ব্যস্ত ছিল। অন্য অংশটি ভাঙচুর করেছে। আরেকটি অংশ লুটপাটে নিয়োজিত ছিল। বিআরটিএর প্রধান কার্যালয় ছাড়াও মিরপুর ১৪ নম্বরে সার্কেল-১ অফিসে আগুন দেয়া হয়।
মহাখালীর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর ও বনানীর সেতু ভবনে আগুন
১৮ই জুলাই মিরপুর-১০ এর মেট্রোরেল স্টেশনে হামলা চালায় আন্দোলনকারীরা। তারা স্টেশনের ভেতরে ব্যাপক ভাঙচুর করে এবং আগুন ধরিয়ে দেয়। এ ছাড়াও সারাদেশে পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কার্যালয়, সরকারী স্থাপনা, পাসপোর্ট অফিস, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোল প্লাজা, ট্রেনে হামলাসহ চতুর্মুখী নাশকতা চালিয়েছিল আন্দোলনকারীরা।
মিরপুরে পুলিশ বক্সে আগুন, চার স্টেশনে মেট্রো বন্ধ
১৮ই জুলাই বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন স্টেশন- বিটিভির কার্যালয়ে হামলা চালায় আন্দোলনকারীরা। পুরো ভবনে আগুন ধরিয়ে দিলে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক যানবাহন ভস্মীভূত হয়, ৬ তলা বিটিভি ভবনের সব বিভাগের মূল্যবান যন্ত্রপাতি, সরঞ্জামসহ গুরুত্বপুর্ণ আর্কাইভ ও নথিপত্র ভস্মীভূত হয়। ঘটনার দশ মাস পরে এক মাদ্রাসা শিক্ষক এই হামলার দায় স্বীকার করে বলেন, ‘আমার ইচ্ছে ছিল বিটিভির কন্ট্রোল রুম দখল করে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে বিজয় ঘোষণা দেওয়ার’।
মেট্রোরেলে আগুন না দিলে, পুলিশ হত্যা না করলে আন্দোলন সফল হতো না, টিভি অনুষ্ঠানে সমন্বয়ক হাসিবের স্বীকারোক্তি
শান্তিরক্ষা মিশন থেকে বাংলাদেশ আর্মিকে প্রত্যাহারের হুমকি
জুলাই-আগস্টের সরকারবিরোধী এই আন্দোলনে বিক্ষোভকারীদের সহিংসতা, ভাঙচুর ও নাশকতা প্রতিরোধে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যেন কোন পদক্ষেপ না নেয়, সেজন্য সতর্ক করেছিলেন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার টুর্ক। গত মার্চ মাসে বিবিসির হার্ড টক অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা স্বীকার করেন। যদিও আন্দোলন চলাকালীন সময়ে এই বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেলে জাতিসংঘ থেকে এই সম্ভাবনার কথা নাকচ করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে ভলকার টুর্ক নিজেই বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে স্বীকার করে নেন তার অবস্থানের কথা।
সারাদেশে পুলিশের ওপর হামলা, থানায় অগ্নিসংযোগ, জঙ্গিদের জেল থেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার মত ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দ্রুত অবনতি হতে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে সরকার সেনাবাহিনী মোতায়েন করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনের চেষ্টা করলে ভলকার টুর্ক সেনাবাহিনীকে নিরস্ত্র করার চেষ্টা করেন এবং সফল হন।
তিনি বলেন, “আমরা প্রকৃতপক্ষে সেনাবাহিনীকে সতর্ক করি, যদি তারা এতে সরকারের কথা শোনে, তার অর্থ দাঁড়াবে- বাংলাদেশ হয়ত আর শান্তিরক্ষী পাঠানো দেশের তালিকায় থাকতে পারবে না। এই কথা তারা শোনে, ফলশ্রুতিতে আমরা পরিবর্তন দেখলাম।”
বিটিভিতে হামলার স্বীকারোক্তি
এই সফলতার পেছনে আরেকটি কারণ ছিল শান্তিরক্ষা মিশনের প্রতি সেনাবাহিনীর দুর্বলতা। একেকটি মিশন থেকে সেনাসদস্যদের বিপুল আয় হয়। যে পারিশ্রমিক তারা এক বছরের মিশনে পান, তা সরকারের দেওয়া ৫ বছরের বেতনের চেয়েও বেশি। তাই সেনা সদস্যদের কাছে শান্তিরক্ষা মিশন খুবই লোভনীয়। আর শান্তিরক্ষা মিশন হাতছাড়া হওয়ার হুমকিতে সেনারা তাদের সর্বাধিনায়কের নির্দেশ উপেক্ষা করে নীরব ভূমিকা পালন করে।
দেশের শান্তি ও নিরাপত্তার কথা বিবেচনা না করে ভলকার টুর্ক নিজেদের স্বার্থ হাসিলের দিকেই বেশি মনোযোগী ছিলেন বিধায় এমন সতর্কতা জারি করেছিলেন।
বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে সতর্ক করেছিলেন, বিবিসিকে ফলকার টুর্ক, কতটা চাপ তৈরি করেছিল জাতিসংঘ?
সিলেক্টিভ মানবতার মানবাধিকার রিপোর্ট
২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে ভলকার টুর্কের অফিস। জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে ঘটে যাওয়া মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা নিয়ে প্রতিবেদনটি সাজানো হয়। যা মূলত ড. ইউনূসের ফরমায়েশেই তৈরি করা হয়েছে বলে জানান প্রধান উপদেষ্টা নিজেই।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তদন্তে ফলকার টুর্ককে চিঠি প্রধান উপদেষ্টার | প্রথম আলো
এই প্রতিবেদনে বলা হয়, জুলাই ১ থেকে আগস্ট ১৫ পর্যন্ত দেড় মাসে ১৪০০ এর বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। এক্ষেত্রে এটা পরিষ্কার হয়নি আন্দোলনে নিহতের প্রকৃত সংখ্যা কত। কারণ ৫ই আগস্ট থেকে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় নেই। তাই ১৫ই আগস্ট পর্যন্ত হত্যাকাণ্ডের দায় শেখ হাসিনার সরকারের ওপর বর্তানোর কোনো যুক্তি নেই।
জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে আন্দোলনে নিহতের সংখ্যা ৮২০ জনের বেশি, অন্তর্বর্তী সরকারের হিসাবে সেটা ৮৩৪।
কোন মৃত্যুই কাম্য নয়, কিন্তু একজনের হত্যাকাণ্ডের দায় অন্যের ঘাড়ে চাপানো ন্যায়বিচার নয়। যদি ৫ই আগস্টের আগের হত্যার দায় আওয়ামী লীগের ওপর চাপানো হয়, তাহলে কেন ১৫ই আগস্ট পর্যন্ত নিহত প্রায় ৬০০ লাশের দায় জাতিসংঘ ড. ইউনূসের সরকারকে দেয়নি? তাদের প্রতিবেদনে শুধুমাত্র ৫ই আগস্ট পর্যন্ত মৃতদের ব্যাপারে তথ্য দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এরপর মাত্র ১৫ দিনে এত বিপুল সংখ্যক নরহত্যার ব্যাপারে কোন বিস্তারিত তথ্য প্রতিবেদনে নেই; এমনকি এ ব্যাপারে কোন সংস্কার পরামর্শও দেওয়া হয়নি তাতে।
আওয়ামী লীগ কর্মীদের হাতে জুলাইতে আহত দাবি করা এক বৈষম্যবিরোধী কর্মী, টাকা হাতিয়ে নিতে এবং মিথ্যা মামলা করতে ব্যান্ডেজ নাটক, যা পরে উদঘাটিত হয়
৫ই আগস্টের পর থেকে যেমন একদিকে বাসাবাড়িতে হামলা, অগ্নিসংযোগ করে হত্যা-লুটপাট করা হয়েছে, তেমনি মব সৃষ্টি করে পিটিয়ে পুলিশে দেওয়া অথবা পুলিশ পাঠিয়ে ধরপাকড় করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতদের সবাইকে বিনা মামলায় আটক করে পরে বানোয়াট মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে হাজতে পাঠানো হয়েছে। মব হামলায় যারা মারা গেছেন, তাদের কারো হত্যা মামলা এখন পর্যন্ত গ্রহণ করা হয়নি। ১৫ই আগস্টের ছয় মাস পরে প্রকাশিত এই মানবাধিকার প্রতিবেদনে আওয়ামী লীগের ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী কোন হামলার কথাও উঠে আসেনি।
জুলাইয়ের নিহতের প্রকৃত সংখ্যা কত?
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ এবং গোয়েন লুইসের বক্তব্য
গত ১২ই মে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করে ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার। এর ফলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় বয়ে যায় এবং অন্তর্ভুক্তিমুলক নির্বাচন আয়োজনে বর্তমানে সরকারের প্রতিশ্রুতি কতটা বাস্তবায়িত হবে সে নিয়ে সংশয় উঠে আসে। এ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে জাতিসংঘের রেসিডেন্ট কোঅর্ডিনেটর গোয়েন লুইস বলেন, জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ না থাকলেও জনগণের অংশগ্রহণ সঠিকভাবে হলে নির্বাচন ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ হতে পারে। তার এ কথাতেই স্পষ্ট হয় যে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের ব্যাপারে জাতিসংঘের বাংলাদেশ কার্যালয়ের কর্মকর্তারা ইন্ধন যুগিয়েছিলেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বাংলাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী প্রাচীনতম দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং তার ১৪ দলীয় জোটের ভোটের হার মোট ভোটারদের প্রায় ৫০%। এই বিপুল সংখ্যক ভোটারকে নির্বাচন থেকে দূরে রেখে কীভাবে অন্তর্ভুক্তিমুলক নির্বাচন নিশ্চিত করা হবে- তা অনেকেই ভেবে কুল পাচ্ছেন না। তবে এখন এর কিছুটা সমাধান স্পষ্ট হচ্ছে, যখন নির্বাচন কমিশন ভোটকেন্দ্রে সংবাদ মাধ্যমের প্রবেশ নিষিদ্ধের উদ্যোগ নিচ্ছে। স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা না থাকলে ৫০ শতাংশের পুরোটাই জাল ভোটের মাধ্যমে অন্তর্ভুক্ত করা হবে আর একে সমর্থন দিবে জাতিসংঘ, এমনটাই মনে করছেন নির্বাচন সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা।
জাতিসংঘকে ড. ইউনূসের ধন্যবাদ জ্ঞাপন কেন?
গত ২৯শে জুলাই জাতিসংঘ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে জুলাই ষড়যন্ত্রে ভূমিকার জন্য জাতিসংঘকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস। তিনি বলেন, ‘গত বছরের জুলাই-আগস্টের অন্ধকার সময়ে জাতিসংঘ বাংলাদেশের পাশে ছিল—সেই সহায়তা ও সংহতির জন্য আমরা গভীরভাবে কৃতজ্ঞ’।
অন্ধকার সময়ে পাশে থাকায় জাতিসংঘের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রধান উপদেষ্টার
এই বক্তব্য আদতে ধন্যবাদ মনে হলেও আসলে এটি একটি স্বীকারোক্তি যে, শেখ হাসিনার নির্বাচিত সরকারের পতন ঘটানোর ষড়যন্ত্রে জাতিসংঘ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে; এটা ছাড়া তাদের ষড়যন্ত্রমূলক উৎখাত আন্দোলন সফল হতোনা; ড. ইউনূসও ক্ষমতায় বসে পশ্চিমা শক্তির তাঁবেদারি করা এবং নিজের ব্যবসার উন্নতি ঘটাতে পারতেন না।
গোয়েন লুইস বারবার বলেন যে, দেশের রাজনীতিতে জাতিসংঘের কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু জুলাই ষড়যন্ত্র চলাকালীন সময়ে, আগস্টের পর এবং এখন পর্যন্ত জাতিসংঘ মানবাধিকারের নামে আওয়ামী লীগের ওপর চালানো দমন-পীড়নকেই বৈধতা দিচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র সমালোচনার পরেও বড় বড় সংঘাতগুলো নিয়ে তাদের নীরবতা দৃশ্যমান।
জুলাই ষড়যন্ত্র পুরোটাই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়, এই তথাকথিত আন্দোলনের এক বছর পূর্তিতে জাতিসংঘ কর্তৃক অনুষ্ঠান আয়োজন পুরোপুরি বেমানান। একইসাথে মানবাধিকার সংস্থার এই অনুষ্ঠানে গত এক বছরেও মানবাধিকার লঙ্ঘনের কোন তথ্য উপস্থাপন করা হয়নি। পুরো অনুষ্ঠানজুড়ে শুধু আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে একচেটিয়া বিষোদগার করা হয়েছে।
বাংলাদেশের ক্ষমতার পট-পরিবর্তন নিয়ে অনেক আগে থেকে পশ্চিমা ষড়যন্ত্রের কথা বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৫ই আগস্টের পর থেকে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ, রাখাইন করিডরের মত ইস্যুতে সেই ষড়যন্ত্র ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়েছে সাধারণ মানুষের কাছে। এক বছর আগে কিছু মানুষ যে স্বপ্ন নিয়ে সরকার পতনের আন্দোলনে নীরব সমর্থন দিয়েছিল, ধীরে ধীরে তাদের সেই সে স্বপ্ন ধূলিস্মাৎ হয়ে গিয়েছে। তারা বুঝতে পারছে এখন, কোন ষড়যন্ত্র রচিত হয়েছিল তাদের ঘিরে।
এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচন দিলে সেখানে যদি আওয়ামী লীগ থাকে, তাহলে বর্তমানে ক্ষমতাধর জামায়াতে ইসলামী ও নিবন্ধনহীন দল এনসিপির ভরাডুবি নিশ্চিত। এমনকি তাদের শীর্ষ নেতাদের জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। সেই আশংকা থেকেই আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে নির্বাচন আয়োজন করা ছাড়া ক্ষমতা ধরে রাখার কোন উপায় ড. ইউনূসের সামনে নাই। আর সেই পরিকল্পনার মূল কুশীলব জাতিসংঘ।