উপ- শিরোনাম, তবে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক প্রকাশিত বিভিন্ন দেশের জন্য নির্ধারিত শুল্ক হারের তালিকা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বাংলাদেশকে দেওয়া ২০% শুল্ক হারটি আসলে ‘Worst deal’ বা সবচেয়ে দুর্বল চুক্তিগুলোর মধ্যে একটি।- আব্দুল কাদের
স্পেশাল প্রতিবেদন
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার পর বাংলাদেশ একটি নতুন বাণিজ্য চুক্তিতে পৌঁছেছে, যেখানে পণ্যের ওপর শুল্ক উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে এটিকে একটি ‘ঐতিহাসিক কূটনৈতিক বিজয়’ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হলেও, প্রাপ্ত তথ্য এবং বিশ্লেষকদের মতামত এক ভিন্ন চিত্র তুলে ধরছে। আপাতদৃষ্টিতে এই সাফল্য বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক মনে হলেও, এর পেছনে রয়েছে বেশ কিছু কঠোর শর্ত, যা দেশের অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক সার্বভৌমত্বকে প্রশ্নের মুখে ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সরকারি ঘোষণা ও বাস্তবতা
আজ ১ আগস্ট, ২০২৫ তারিখে ‘ প্রধান উপদেষ্টা বা চিফ অ্যাডভাইজার (GoV)’ নামক একটি ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ থেকে এক পোস্টে বলা হয়, “আমরা গর্বের সাথে বাংলাদেশ ট্যারিফ আলোচকদের অভিনন্দন জানাই… শুল্ক ২০% এ কমিয়ে আনার মাধ্যমে, যা প্রত্যাশার চেয়ে ১৭ পয়েন্ট কম, আমাদের আলোচকরা অসাধারণ কৌশলগত দক্ষতা দেখিয়েছেন।” এই ঘোষণায় চুক্তিটিকে বাংলাদেশের জন্য একটি বড় বিজয় হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
তবে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক প্রকাশিত বিভিন্ন দেশের জন্য নির্ধারিত শুল্ক হারের তালিকা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বাংলাদেশকে দেওয়া ২০% শুল্ক হারটি আসলে ‘Worst deal’ বা সবচেয়ে দুর্বল চুক্তিগুলোর মধ্যে একটি। প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী:
৩টি দেশ ১০% শুল্কে ‘Best deal’ পেয়েছে।
৩৯টি দেশ ১৫% শুল্কে ‘Second best deal’ পেয়েছে।
এমনকি কম্বোডিয়ার মতো দেশও ১৯% শুল্ক হার পেয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে, ২০% শুল্ক হারকে সরকারের পক্ষ থেকে ‘ঐতিহাসিক বিজয়’ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হলেও, তথ্য-উপাত্ত বলছে এটি অন্য অনেক দেশের তুলনায় একটি দুর্বল সমঝোতা।
চুক্তির আড়ালে যেসব শর্তাবলী রয়েছে বলে অভিযোগ
বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এই শুল্ক হ্রাসের সুবিধা পেতে বাংলাদেশকে বেশ কিছু কঠিন শর্ত মেনে নিতে হয়েছে। এই শর্তগুলো মূলত বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। প্রধান শর্তগুলো হলো:
১. বিমান ক্রয়: মার্কিন বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বোয়িং-এর কাছ থেকে ২৫টি বিমান ক্রয়ের জন্য বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিশ্রুতি দিতে হয়েছে।
২. উচ্চমূল্যে গম আমদানি: বাংলাদেশকে তুলনামূলক কম মূল্যের ইউক্রেন বা রাশিয়ার বাজার ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে চড়া দামে গম কিনতে হবে। চুক্তি অনুযায়ী, আগামী পাঁচ বছরের জন্য বাংলাদেশ প্রতি বছর যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৭ লক্ষ মেট্রিক টন গম আমদানি করতে বাধ্য থাকবে।
৩. রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক সীমিতকরণ: রাশিয়ার সাথে চলমান এবং ভবিষ্যৎ বাণিজ্যিক ও সামরিক চুক্তিগুলো ধীরে ধীরে বাতিল করার শর্ত দেওয়া হয়েছে।
৪. ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা: মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ দেশ ইরানের সঙ্গে সব ধরনের বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে।
৫. ভূরাজনৈতিক ও নিরাপত্তা সমঝোতা: এই বাণিজ্যিক চুক্তির আওতায় যুক্তরাষ্ট্রর সাথে বিভিন্ন নিরাপত্তা ও ভূরাজনৈতিক ইস্যুতে বাংলাদেশকে সমঝোতামূলক অবস্থান গ্রহণ করতে হবে, যা দেশের স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
বিশ্লেষকদের অভিমত
অর্থনীতিবিদ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই শর্তগুলো মেনে নেওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশ আপাতদৃষ্টিতে শুল্ক কমানোর সুবিধা পেলেও দীর্ঘমেয়াদে দেশটির অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব মারাত্মকভাবে খর্ব হতে পারে। বিশেষ করে, নির্দিষ্ট দেশ থেকে উচ্চমূল্যে পণ্য ক্রয় এবং অন্যান্য দেশের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার মতো শর্তগুলো বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের একটি অর্থনৈতিক উপনিবেশে পরিণত করতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন তারা।
তাঁদের মতে, সরকার যেটিকে ‘প্রত্যাশার চেয়ে ১৭ পয়েন্ট কম’ বলে প্রচার করছে, তা সম্ভবত দর-কষাকষির আগের সর্বোচ্চ শুল্কহার (সম্ভবত ৩৫% বা ৪১%) এর তুলনায় বলা হচ্ছে। কিন্তু অন্যান্য দেশ যখন ১০% বা ১৫% শুল্কে চুক্তি করতে পেরেছে, তখন ২০% শুল্ক কোনোভাবেই সেরা চুক্তি হতে পারে না।
সব মিলিয়ে, সরকারের ঘোষিত ‘সাফল্য’ এবং এই চুক্তির পেছনের কঠোর শর্তাবলী ও তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব নিয়ে জনমনে ও বিশেষজ্ঞ মহলে ব্যাপক প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। এই চুক্তিটি কি আসলেই বাংলাদেশের জন্য একটি বিজয়, নাকি ভবিষ্যতের জন্য একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত—তা সময়ই বলে দেবে।