মাদারীপুর সদর উপজেলার মস্তফাপুর ইউনিয়নে দুটি মন্দিরে প্রতিমা ভাঙা হয়েছে গভীর রাতে। শ্রীশ্রী গণেশ পাগলের মন্দির ও রাধাকৃষ্ণ মন্দির, দুইটিই পাশাপাশি। দুটিই স্থানীয় মানুষের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক চেতনার অংশ। আর এই দুটি জায়গাতেই কেউ বা কারা এসে রাতের আঁধারে ভেঙে দিয়ে গেছে প্রতিমা।
এই ‘কে বা কারা’ আসলে আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থার এক পুরনো ছায়া। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপরে হামলার পর প্রতিবারই প্রশাসনের বক্তব্য অভিন্ন : “তদন্ত চলছে”, “আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে”, “অপরাধী কেউ রেহাই পাবে না” – এই আশ্বাসের পুনরাবৃত্তি এমন এক স্তরে পৌঁছেছে, যেখানে শব্দগুলো অর্থ হারিয়ে ফেলে।
বাংলাদেশে প্রতিমা ভাঙার ঘটনা বিচ্ছিন্ন নয়। বরং এ এক বর্বরোচিত ধারাবাহিকতা, যা প্রতি বছর কোনো না কোনো উপলক্ষে ফিরে আসে—ভোটের আগে, জমি দখলের সময়, পুরনো বিরোধে শাসকপন্থীদের সুবিধার্থে কিংবা নিছক উগ্র মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, এসব ঘটনায় অপরাধীদের শনাক্ত, গ্রেপ্তার কিংবা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির উদাহরণ খুবই দুর্লভ। এর ফলেই প্রতিমা ভাঙার মতো ঘটনা যেন দিনে দিনে স্বাভাবিক হয়ে উঠছে।
এই দায় শুধুমাত্র হামলাকারীর নয়। এটি একটি প্রশাসনিক ব্যর্থতা, নৈতিক শূন্যতা এবং রাজনৈতিক প্রতিপালনের ইঙ্গিতবাহী। রাষ্ট্রের দায় হল প্রতিটি নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা—তা সে সংখ্যাগরিষ্ঠ হোক বা সংখ্যালঘু। যখন একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের মানুষ বারবার হামলার শিকার হয়, তখন শুধু ‘আইনশৃঙ্খলা’ দিয়ে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা চলে না।
বাংলাদেশের সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সব ধর্মের সমান অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলে। অথচ বাস্তবে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রতিমা, উপাসনালয়, উৎসব, জমি—সবই হামলার আশঙ্কায় দিন কাটায়। এই বৈষম্য শুধু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য অপমানজনক নয়, রাষ্ট্রের সার্বিক গণতান্ত্রিক অবস্থানের জন্যও হুমকি।
ধর্মীয় সহিংসতা কোনো সময়েই শুধু একটি সম্প্রদায়ের সমস্যা থাকে না। সমাজের ওপর দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব পড়ে। অবিশ্বাস তৈরি হয়, ভীতি বাড়ে, নাগরিকত্বের বোধে ফাটল ধরে। আমরা কি এমন বাংলাদেশ চেয়েছিলাম?
প্রতিমা ভাঙার শব্দটা খুব বেশি দূর যায় না। হয়তো সকালে গিয়ে দেখা যায় কিছু মূর্তি পড়ে আছে, কিছু ফুল ছড়িয়ে ছিটিয়ে, কিছু চোখে পানি। কিন্তু এর প্রতিধ্বনি গিয়ে লাগে রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামোয়। ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার—এই কথাটাই আজ প্রশ্নবিদ্ধ। আর সে প্রশ্ন থেকে দায় সরে দাঁড়ানোর সুযোগ কারো নেই।