সংরক্ষিত আসন বাড়ানোর পাশাপাশি সরাসরি ভোটের দাবি জানিয়ে আসছেন নারী অধিকারকর্মীরা। কিন্তু সেই দাবি আদায়ে রাজনৈতিক দলগুলোকেই তারা বাধা হিসেবে সামনে পাচ্ছেন।
‘নতুন’ বাংলাদেশেও রাজনীতির প্যাঁচে আটকে থাকবে নারীর প্রতিনিধিত্ব? চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থানের পর অনেকেই আশাবাদী হয়ে উঠেছিলেন, এবার হয়ত সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্ব বাড়ানো এবং সরাসরি নির্বাচনের সুযোগ মিলবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর অনাগ্রহ আর মতভিন্নতার মধ্যে জাতীয় সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্ব নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে, তাতে অধিকারকর্মীরা হতাশ ও ক্ষুব্ধ।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ খুব স্পষ্ট করেই বলেছেন, “নারীবির্বজিত কমিশন (জাতীয় ঐকমত্য কমিশন) বসে নারীর বিষয় নির্ধারণ করছে। আমি ভীষণভাবে অস্বস্তিতে ভুগছি।”
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন ঐকমত্য কমিশনের সাত সদস্যের মধ্যে কোনা নারী প্রতিনিধি নেই।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এই কমিশনের শেষ বৈঠকের দিন ৩১ জুলাই সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে যে ছবি তোলা হয়েছিল, সেখানে ৪৫ জনের মধ্যে নারী ছিলেন মাত্রা চারজন।
চার দশকের বেশি সময় ধরে দেশের প্রধান দুই দলের শীর্ষ পদে নারীরাই আছেন; তিন দশকের বেশি সময় তারাই সরকার পরিচালনা করেছেন; তারপরও রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণে সাম্য আনা যায়নি।
নিবন্ধনের শর্ত পূরণে রাজনৈতিক দলের সব পর্যায়ে ৩৩ শতাংশ নারী নেতৃত্ব নিশ্চিত করার আইনি বাধ্যবাধকতা থাকলেও ছোট বড় সব রাজনৈতিক দল সেখানে ব্যর্থ।
গত বছরের জুলাই-অগাস্টের আন্দোলনে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নারীর অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মত। ফলে অন্তর্বর্তী সরকার যখন রাষ্ট্র সংস্কারের কাজে হাত দিল, তখন অনেকেই আশাবাদী হয়ে উঠেছিলেন, এবার হয়ত সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্ব বাড়ানো এবং সরাসরি নির্বাচনের সুযোগ মিলবে।
কিন্তু কিছু রাজনৈতিক দলের আপত্তিতে ‘ক্রমান্বয়ে ১০০ আসন সংরক্ষণের’ সিদ্ধান্ত এসেছে ঐকমত্য কমিশনে, যা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রেসিডেন্ট ফওজিয়া মোসলেম।
তিনি বলেন, “আমরা এরকম ধাপে ধাপে বাড়ানো চাই না। আমরা যেটা বলতে চাই, সংসদের সামগ্রিক আসন বাড়ানো হোক, ৩০০ সিট আছে, আরও ১৫০টা সিট সংরক্ষিত মহিলা আসন হিসেবে রাখা হোক। সেখানে সরাসরি ভোট হোক। এই দুটো আমাদের চাহিদা।”
৬৭টি নারী, মানবাধিকার ও উন্নয়ন সংগঠনের প্ল্যাটফরম ‘সামাজিক প্রতিরোধ কমিটি’ও ঐকমত্য কমিশনের ওই সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেছে।
তারা বলছে, একটি গণতান্ত্রিক, সমতাভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন বিষয়ে নারী সমাজের দীর্ঘদিনের আন্দোলন ও দাবিকে ‘গুরুত্ব’ দেওয়া হয়নি।
আর ঐকমত্য কমিশনের সভার সিদ্ধান্তকে ‘পুরুষতান্ত্রিক পশ্চাৎপদ চিন্তার প্রকাশ’ বলে মনে করছে সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরাম। মঙ্গলবার তারা ঢাকায় প্রতিবাদ সমাবেশ করে ওই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার দাবি জানিয়েছে।
নারী প্রতিনিধিত্ব নিয়ে এ পর্যন্ত যা হল, নির্বাচন বিশ্লেষক আব্দুল আলীমও তা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন।
তবে তিনি মনে করেন, ঐকমত্য কমিশন এখনো বিষয়টি নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যেতে পারে। তাদের যদি বোঝানো সম্ভব হয়, তাহলেই মঙ্গল আসবে। না হলে বাস্তবিক কোনো পরিবর্তন হয়ত দেখা যাবে না।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার অবশ্য সে সুযোগ দেখছেন না।
তিনি বলছেন, “আমাদের খুব একটা কিছু করার আছে বলে মনে হয় না। রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজি করাতে পারিনি।”
সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি নির্বাচনের দাবিতে ১২ জুলাই সমাবেশ ও শোভাযাত্রা করে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ।
সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি নির্বাচনের দাবিতে ১২ জুলাই সমাবেশ ও শোভাযাত্রা করে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ।
সংরক্ষণ বনাম অধিকার
সরাসরি ভোটের জন্য ৩০০ সংসদীয় আসনের বিপরীতে ১৯৭৩ সালে ১৫ আসন ছিল সংরক্ষিত নারী আসন। পরে তা বাড়িয়ে দ্বিতীয়, তৃতীয়, পঞ্চম, ষষ্ট ও সপ্তম সংসদে ৩০টি আসন করা হয়।
আইনের মেয়াদ না থাকায় চতুর্থ সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন ছিল না। মেয়াদ না থাকায় অষ্টম সংসদের শুরুতেও নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন ছিল না। তবে ২০০৪ সালে সংবিধানের চতুর্থদশ সংশোধনী এনে আসন বাড়িয়ে ৪৫ করা হয়।
নবম সংসদেও শুরুতে ৪৫টি আসন সংরক্ষিত ছিল। ওই সংসদেই ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধনীতে আরও ৫ আসন বাড়িয়ে সংরক্ষিত আসন করা হয় ৫০টি।
এসব আসনের মেয়াদ আরও ২৫ বছর বহাল রেখে সংবিধানের সপ্তদশ সংশোধনী আনা হয় ২০১৮ সালে। সে অনুযায়ী, ২০৪৩ সাল পর্যন্ত সংসদে ৫০টি আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকার কথা।
সরাসরি নির্বাচিত হয়ে আসা ৩০০ সংসদ সদস্যের সংসদীয় এলাকা নির্ধারিত থাকলেও সংরক্ষিত আসনের এমপিদের এলাকাভিত্তিক কার্যপরিধি বা দায়িত্বের বিষয়ে সংবিধানে আলাদাভাবে কিছু নেই। ফলে ভোটারদের সঙ্গে সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্যদের সরাসরি কোনো সংযোগ ঘটে না।
সে কারণেই সংরক্ষিত আসন বাড়ানোর পাশাপাশি সেসব আসনে সরাসরি ভোটের দাবি জানিয়ে আসছে নারী অধিকারকর্মীরা। কিন্তু সেই দাবি আদায়ে রাজনৈতিক দলগুলোকেই তারা বাধা হিসেবে সামনে পাচ্ছেন।
ঐকমত্যের বাহাস
অন্তর্বর্তী সরকার যে ১১টি সংস্কার কমিশন করেছিল, তার মধ্যে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন সংসদীয় আসনের সংখ্যা ৬০০ তে উন্নীত করে ৩০০ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষণের সুপারিশ করেছিল।
কিন্তু ঐকমত্য কমিশন যেসব সুপারিশ নিয়ে কাজ করেছে, সেখানে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের জায়গা হয়নি।
সংরক্ষিত নারী আসনের বিষয়ে সংবিধান সংস্কার কমিশন ও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের আলাদা দুটি প্রস্তাব ছিল। সংরক্ষিত নারী আসন বাড়িয়ে ১০০ করার পাশাপাশি সরাসরি ভোটের প্রস্তাব করেছিল দুই কমিশনই।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, সংরক্ষিত ১০০টি নির্বাচনী এলাকায় কেবল নারী প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে, এর মধ্য দিয়ে নারী সদস্যরা সরাসরি নির্বাচিত হবেন।
আর নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন সংরক্ষিত ১০০ আসনে ‘ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে’ সরাসরি ভোটের প্রস্তাব করে।
এ প্রস্তাব অনুযায়ী, সংসদে নির্বাচনী এলাকা হবে ৪০০। এর মধ্যে ১০০টি নারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। প্রথমবার দ্বৈবচয়ন বা অন্য কোনো পদ্ধতিতে ঠিক করা হবে, কোন ১০০টি আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত হবে। পরের সংসদ নির্বাচনে অন্য ১০০টি আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত হবে। এভাবে সংরক্ষিত নারী আসন ঘুরতে থাকবে বলে একে ‘ঘূর্ণায়মান পদ্ধতি’ বলা হচ্ছে।
ঐকমত্যের সংলাপে ওই দুই প্রস্তাবের কোনোটিতেই একমত হতে পারেনি রাজনৈতিক দলগুলো।
ঐকমত্য কমিশন তখন নতুন একটি প্রস্তাব দেয়। সেখানে বলা হয়, জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন বিলুপ্ত হবে। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যেসব দল ন্যূনতম ২৫টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে, সেসব দল তাদের মোট প্রার্থীর মধ্যে কমপক্ষে এক-তৃতীয়াংশ আসনে নারী প্রার্থিতা নিশ্চিত করবে। সেজন্য সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা হবে। রাজনৈতিক দলগুলো এ প্রস্তাবেও একমত হয়নি।
কমিশন তখন সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন ৫০ থেকে বাড়িয়ে ১০০ করা এবং সরাসরি ভোটের প্রস্তাব রাখে। দলগুলো তাতেও একমত হতে পারেনি।
এরপর ঐকমত্য কমিশন ৫০টি সংরক্ষিত আসন বহাল রেখে ৩০০ সাধারণ আসনের ৫-৭ শতাংশ আসনে নারী প্রার্থী মনোনয়নের প্রস্তাব দেয়। এ প্রস্তাবেও মতৈক্য আসেনি।
আলোচনার শেষ দিন কমিশনের সহ সভাপতি আলী রীয়াজ বলেন, সংসদে নারী আসন বৃদ্ধি এবং সরাসরি ভোটে নির্বাচন বিষয়ে মোট পাঁচ দিন আলোচনা হয়। কমিশনের পক্ষ থেকে একাধিক সংশোধিত প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়। এসব প্রস্তাবের লক্ষ্য ছিল জাতীয় সংসদে নারীদের প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা।
“কিন্তু যদিও নারী আসন বৃদ্ধি করে ১০০ আসনে উন্নীত করার বিষয়ে কার্যত প্রায় সব দল একমত, কিন্তু কী প্রক্রিয়ায় তা বাস্তবায়িত হবে সেই বিষয়ে কোনো ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। ফলে শেষ পর্যন্ত বিদ্যমান পরোক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থা বহাল রেখে পর্যায়ক্রমিকভাবে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়।
“এটা দুঃখজনক যে, এই সিদ্ধান্তের ব্যাপারে দলসমূহের পক্ষ থেকে সবচেয়ে বেশি নোট অব ডিসেন্ট দেয়া হয়েছে।”
কমিশনের সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধনী এনে বিদ্যমান ৫০টি সংরক্ষিত আসন বহাল রাখা হবে। পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে প্রতিটি রাজনৈতিক দল বিদ্যমান ৩০০ সংসদীয় আসনের জন্য ন্যূনতম ৫ শতাংশ নারী প্রার্থীকে মনোনয়ন দেবে। তার পরের নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো ন্যূনতম ১০ শতাংশ নারী প্রার্থী মনোনয়ন দেবে।
ন্যূনতম ৩৩ শতাংশ নারী প্রার্থী মনোনয়নের লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে প্রতিটি সাধারণ নির্বাচনে ন্যূনতম ৫ শতাংশ বর্ধিত হারে নারী প্রার্থী মনোনয়ন অব্যাহত থাকবে। এ বিধান সংবিধানে যুক্ত হবে।
সংবিধানে সপ্তদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংরক্ষিত নারী আসনের মেয়াদ ২৫ বছর বৃদ্ধি করা হয়, হিসাব অনুযায়ী তা ২০৪৩ সাল পর্যন্ত বহাল থাকবে৷ তবে প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে ৩৩ শতাংশ নারী প্রার্থিতার লক্ষ্য ২০৪৩ সালের আগেই যদি অর্জিত হয়, তাহলে সপ্তদশ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রবর্তিত বিধান নির্ধারিত সময়ের আগেই বাতিল হয়ে যাবে।
আশাভঙ্গ
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ও সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক ফওজিয়া মোসলেম ঐকমত্য কমিশনের সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়া নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন।
“উনারা ধাপে ধাপে উন্নয়ন করবেন; কিন্তু উনারা তো নারীদের কোনো মতামত নেননি। কোনো মহিলা সংগঠন, কোন নারী প্রতিনিধি উনাদের ওখানে ছিল না। এমনকি নারী সংস্কার কমিশনের যে একটা প্রস্তাব ছিল নির্বাচন সম্পর্কিত, সেটাও উনারা বিবেচনায় আনেননি।”
সংরক্ষিত আসন বাড়িয়ে ১৫০টি করার পাশাপাশি সেসব আসনে সরাসরি ভোটের বিধান চেয়ে তিনি বলেন, “তাহলে পরে তাদের একটা ওনারশিপ হয়, মানুষের কাছে একটা দায়বদ্ধতা হয়, না হলে পরে শুধুমাত্র ওই সংখ্যা বাড়ালাম আর সংখ্যা বাড়িয়ে মনোনয়ন দিলাম, এইটাতে নারীর কোনো লাভ হয় না। যারা থাকেন, তারাও তাদের যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারেন না।”
এ নারী নেত্রী বলেন, “আমরা এটাও চাই যে, জেনারেল যে আসন আছে, সেখানে কমপক্ষে ৩৩ শতাংশ আসনে নারী প্রার্থীদের মনোনয়ন দেবে প্রত্যেকটা রাজনৈতিক দল। এই দুটা আমাদের চাহিদা। ঐক্যমত কমিশন যেটা চাচ্ছেন, সেটার সাথে আমরা একমত না।“
সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরাম কেন্দ্রীয় কমিটির দপ্তর সম্পাদক রুখশানা আফরোজ আশা বলেন, “নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, বাসদ ও সিপিবির প্রস্তাবেও ছিল। কিন্তু কোনো প্রকার আলোচনা ছাড়াই ঐকমত্য কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। কেন এটা বাস্তবায়ন হবে না সেটারও যৌক্তিক আলোচনা নেই।
“আমরা সরাসরি নির্বাচনের কথা অনেকদিন ধরে বলে এসেছি। এবার সুযোগ ছিল আলোচনার বা সিদ্ধান্ত নেওয়ার। ঐকমত্য কমিশন পক্ষপাতমূলকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”
৬৭টি নারী, মানবাধিকার ও উন্নয়ন সংগঠনের প্ল্যাটফরম ‘সামাজিক প্রতিরোধ কমিটি’ এক বিবৃতিতে ঐকমত্য কমিশনের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা আহ্বান জানিয়েছে।
তাদের দাবি, জাতীয় সংসদে মোট আসন সংখ্যা বাড়িয়ে ৪৫০ করতে হবে, যেখানে ১৫০টি আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। তাদের নির্বাচনী এলাকা সুনির্দিষ্ট করা থাকবে এবং জনগণের সরাসরি ভোটের মাধ্যমে সেসব আসনে নারী প্রার্থীরা নির্বাচিত হবেন।
নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন গত ১৯ এপ্রিল প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়। সংরক্ষিত নারী আসন নিয়ে এ কমিশনের সুপারিশ আমলে নেওয়া হয়নি।
নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন গত ১৯ এপ্রিল প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়। সংরক্ষিত নারী আসন নিয়ে এ কমিশনের সুপারিশ আমলে নেওয়া হয়নি।
পরোক্ষের পক্ষে, প্রত্যক্ষে ‘না’
একাদশ সংসদে সংরক্ষিত আসনের ৫০ জন নারী এমপির সঙ্গে সরাসরি ভোটে সাধারণ আসনে নির্বাচিত এমপি ছিলেন ২৩ জন। ওই সংসদে নারী প্রতিনিধিত্বের হার ছিল ২০.৮ শতাংশ, যা বাংলাদেশের সংসদীয় ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে ধর্মভিত্তিক দলগুলো।
নিবন্ধিত ১২টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে সবচেয়ে বড় দল জামায়াতে ইসলামী সংসদ নির্বাচনে কখনো নারী প্রার্থী দেয়নি। তবে পঞ্চম সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনে জামায়াতের দুজন এবং অষ্টম সংসদে তিনজন নারী এমপি ছিলেন।
এখন সংসদে নারী আসন নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সিদ্ধান্ত জামায়াত কীভাবে বাস্তবায়ন করবে?
এ প্রশ্নে দলটির নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, “আমরা সংখ্যানুপাতিক হারে ১০০ সংরক্ষিত আসনের নারী প্রার্থী দেওয়ার কথা বলেছি। সেই ক্ষেত্রে সারা দেশে আমাদের দলের নেতাকর্মী বর্তমানে ৪৫ শতাংশ নারী, সুতরাং আমাদের সংসদে নারী আসনে আমাদের কোন সমস্যা হবে না।
“আর আমাদের দাবি জাতীয় সংসদের নির্বাচন সংখ্যানুপাতিক হারে হবে, সেই ক্ষেত্রে আমরা ৪৫ ভাগ নারী প্রতিনিধিত্ব করতেও সমস্যা হবে না। কিন্তু সরাসরি নির্বাচনে নারী প্রার্থী আমরা বলেছি দেব না, তারপরেও নির্বাচন কমিশনের ফাইনাল সিদ্ধান্তের পরে দেখব কী করা যায়।”
আরেক প্রশ্নের জবাবে জামায়াতের নায়েবে আমির বলেন, “এ পর্যন্ত আমাদের কোনো নারী প্রার্থী সরাসরি নির্বাচনে অংশ নেয়নি। পিআর পদ্ধতিতে হলে তো আর সমস্যা নাই।”
আরেক ধর্মভিত্তিক দল ইসলামি আন্দোলনের প্রেসিডিয়াম সদস্য আশরাফ আলী আকন বলেন, “আমরা নারী আসন বাড়িয়ে ৩০০ করতে বলেছি ঐকমত্য কমিশনকে। আমাদের দলের প্রায় ৫৫ শতাংশ নারী। সেক্ষেত্রে আমরা বেশি দাবি করতেই পারি।
“কিন্তু সরাসরি মাঠের রাজনীতিতে নারীরা কীভাবে পুরুষের মত করে লড়বেন? আমরা নির্বাচন কমিশন এবং ঐকমত্য কমিশনকে বলেছি, নির্বাচনে কোন নারী প্রার্থীকে সরাসরি ভোট করতে মনোনয়ন দেব না। পিআার পদ্ধতিতে আমরা নারী সংসদ সদস্য হিসেবে ৫৫ ভাগ দিতে পারব।“
অতীতে ইসলামি আন্দোলনের কতজন নারী সরাসরি ভোটে জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন জানতে চাইলে আশরাফ আলী আকন বলেন, “আমাদের কোনো প্রার্থী এ পর্যন্ত নির্বাচনে সরাসরি অংশ নেয়নি। ভবিষ্যতেও আমরা সরাসরি নির্বাচনে প্রার্থী দেব না, এটা স্পষ্ট নির্বাচন কমিশন ও ঐকমত্য কমিশনকে বলে দিয়েছি।”
দেশের বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি চার দশকের বেশি সময় ধরে একজন নারীর নেতৃত্বে এগিয়ে চললেও দলের সব স্তরে ৩৩ শতাংশ নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে পারেনি।
ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে বিএনপিও নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনের সংখ্যা ৫০ থেকে বাড়িয়ে ১০০ করতে রাজি হয়েছে। কিন্তু তা হতে হবে আগের মত দলীয় আসন সংখ্যার অনুপাতে। অর্থাৎ, সংরক্ষিত আসনে সরাসরি ভোটে রাজি নয় তারা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, “এখানে অনেক বিতর্ক আছে, কেউ সরাসরি নির্বাচন চায়, কিছু প্রস্তাব আছে বাই রোটেশন পদ্ধতিতে, যেটা কোথাও এক্সপেরিমেন্টে টেকেনি।
“কেউ কেউ চায় নির্ধারিত সীমানা নির্ধারণ করে নারী আসন ফিক্সড হোক, তিন আসনকে একটি ধরে ৩০০ আসনে একশটি নারী আসন থাকুক। সাধারণ আসনের তিনটি নিয়ে আরেকটি নারী আসন হলে ‘ওভারল্যাপিং’ হবে, এটা বাস্তবসম্মত কিনা।
“সব তর্ক বিতর্ক মাথায় নিয়ে আমরা দেখেছি, সরাসরি নির্বাচনের ক্ষেত্রে একটা অপশন রাখা ভালো। নারী সমাজের সেন্টিমেন্ট রয়েছে, তারা সরাসির নির্বাচন চায়, সামাজিক অগ্রসরতা সে পর্যায়ে এসেছে কিনা আমাদের মাথায় রাখতে হবে। সেজন্য আমরা গ্র্যাজুয়ালি যাওয়ার ক্ষেত্রে একমত হয়েছি।”
সালাহউদ্দিন বলেন, “সংশোধনের আগে আসন্ন নির্বাচনে বিএনপি ৫ শতাংশ আসনে বা ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫টি আসনে সরাসরি নারী প্রার্থী মনোনয়ন দেবে। সংবিধান সংশোধন হলে ২০৩১ সালে ৩০টি আসন বা ১০ শতাংশ মনোনয়ন দেবে।
“পরবর্তীকে সমাজের অগ্রগতি বিবেচনায় সময় নিয়ে নিতে হবে। এখন সংরক্ষিত না রেখে সরাসরি নির্বাচন দিলে কতজন আসতে পারবে, তা দেখতে হবে।”
৩১ জুলাই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকের শেষ দিন এক ফ্রেমে সবাই। সেখানেও নারীর উপস্থিতি নগণ্য।
৩১ জুলাই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকের শেষ দিন এক ফ্রেমে সবাই। সেখানেও নারীর উপস্থিতি নগণ্য।
‘অধিকার অর্জন করতে হয়’
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য আব্দুল আলীম বলেন, “নারীর অংশগ্রহণ নিয়ে এখন পর্যন্ত যে সিদ্ধান্ত, সেটা হতাশাজনক। অর্ধেক জনসংখ্যা যেখানে নারী, তাদের বাদ দিয়ে দেশের উন্নয়ন, পার্টিসিপেশন এগুলো কিছুই নিশ্চিত করতে পারব না। যেভাবে সিদ্ধান্তগুলো হচ্ছে, এটা অনাকাঙ্ক্ষিত, এটার পরিবর্তন হওয়া দরকার। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, পলিটিক্যাল পার্টির মাইন্ডসেট।”
এ বিষয়ে আরো আলোচনার তাগিদ দিয়ে এ নির্বাচন বিশ্লেষক বলেন, “এখনও যদি আলোচনা করে ঐকমত্যে আসা যায়, সেটা ভালো হবে। এখনও যারা ভিন্নমত দিচ্ছে, তাদের নিয়ে ঐকমত্য কমিশনের আবার বসা দরকার, বসে কনসেনসাস দরকার। তা না হলে পরিবর্তন দেখতে পাব না।”
তবে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার বলছেন, এখন আর ‘তেমন কিছু করার নেই’।
“আমি বহুভাবে চেষ্টা করেছি, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন থেকে একটা প্রস্তাব করেছি আমরা; ঐকমত্য কমিশনেও সর্বোতভাবে চেষ্টা করেছি। নারী নেত্রীদের সঙ্গে কথা বলেছি, লিখেছি; যাতে তারা এগিয়ে আসে সোচ্চার হয়। কিন্তু কেউ সোচ্চার হয়নি। এখন উষ্মা প্রকাশ করছেন, তাদের অসন্তুষ্টি প্রকাশ করছেন।”
‘কেউ কাউকে অধিকার দেয় না’ মন্তব্য করে এ গবেষক বলেন, অধিকার ‘অর্জন করতে হয়’।
“এখন সিভিল সোসাইটি, নারী সংগঠনকে রাজনৈতিক দলের ওপর চাপ দিতে হবে, রাজনৈতিক দলের কাছে যেতে হবে। আমরা চেষ্টা করেছি যাতে ১০০ আসনে নারীদের জন্য সরাসির নির্বাচন করা যায়, নারীর সত্যিকার রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন যাতে হয়। কিন্তু নারীরাই নিশ্চুপ ছিল।” (বিডিনিউজ ২৪ ¬থেকে)