।। মাহবুব ময়ূখ রিশাদ।।
ভেঙে পড়া শহর, দুঃশাসনের শহর, রক্তপাতের শহর ছিল গোথাম সিটি। সেই গোথাম সিটির রক্ষাকর্তা হয়ে যখন ব্যাটম্যান এলো তখন সেই শহরের মানুষ আবার বাঁচতে, স্বপ্ন দেখতে শিখল। বব কেইন ও বিল ফিঙ্গারের ব্যাটম্যান যদিও কাল্পনিক নায়ক, তবে সেই কল্পনা বাস্তবের কথাও বলে। ব্যাটম্যান কোনো অতিপ্রাকৃতিক যোগ্যতায় নয়, বরং নিজ অধ্যবসায়ে নায়কে পরিণত। এবং যুগে যুগে হয়তো অন্যায়ে আকীর্ণ শহরে এমন মানুষ এসেছে, মাসিয়াহ হিসেবে। হুমায়ুন আজাদের ভাষায় ‘যাদুকর’ হিসেবে।
সম্প্রতি হাতে তুলে নিয়েছিলাম হুমায়ুন আজাদের গল্পগ্রন্থ ‘যাদুকরের মৃত্যু’। তাঁর তীব্র রাজনৈতিক বক্তব্য কিংবা প্রথাবিরোধী ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও জীবন নিয়ে আলোচনা যতটা হয়, তাঁর অমিত শক্তিধর সাহিত্যিক সত্তা নিয়ে সাধারণ পাঠকদের ভেতর তেমন আলোচনা হয় না বলতে গেলে। এমনকি যাদুকরের মৃত্যু গল্প বা বইটি নিয়ে কোনো আলোচনা একাধিক মাধ্যমে খুঁজেছি, পাইনি। যে বই বাংলা গল্পে নতুন আঙ্গিক নিয়ে আসা স্বল্প সংখ্যক বইগুলোর একটি, সেটি নিয়ে কোনো আলাপ নেই, কোনো কথা নেই– এ নিয়ে অবাক হচ্ছি কেন। যাদুকরের মৃত্যু গল্পে লেখক তো নিজেই বলেছেন, বর্বররা আসার পর মানুষের সব স্বপ্ন মরে যাচ্ছে, মানুষের সব সুখ উড়ে যাচ্ছে, মানুষ দুঃখকে জড়িয়ে নিচ্ছে প্রেমের মতো করে, অপরাধ দেখে হয়ে পড়ছে নির্লিপ্ত, ভাবছে এটাই স্বাভাবিক। সেখানে এমন গল্পগ্রন্থ আরও অসংখ্য গতানুগতিকের নিচে চাপা পড়ে যেতেই পারে।
হুমায়ুন আজাদের ‘যাদুকরের মৃত্যু’ গল্পগ্রন্থে স্থান পাওয়া লেখাগুলো কয়েক দশক আগে রচিত, অথচ মনে হয় আজ লেখা। এত বেশি জীবন্ত। আমাদের জীবন বদলে যায়নি। এখনও আমরা স্বপ্ন দেখি না, আমরা কেবল বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করি। এখনও আমরা সুখী হতে পারি না, সুখের অভিনয় করি। নিজ থেকে এগিয়েও যাই না, আমরা অপেক্ষা করি একজন যাদুকর আসবেন, যিনি আমাদের রক্ষা করবেন। একটা গল্প তখন কাল ছাপিয়ে যেতে পারে যখন তা দৈনন্দিনতার মলিনতা অতিক্রম করে যায়। মানুষের ধ্রুব অনুভব, ধ্রুপদি গোথাম সিটির চিরায়ত অস্তিত্ব সংকটের সঙ্গে যুগে যুগে সমস্ত মানুষের পরিচয় ঘটেছে। শুভশক্তির বিজয় দেখতে চাওয়া মানুষ অনাদি কাল থেকে এতে অভ্যস্ত হতে চায়নি। মুক্তির স্বপ্নটা তারা মলিন হতে দেয়নি। যুদ্ধ আর সংগ্রাম থেকে মানুষের মুক্তি মিলছে না অথচ তার স্বপ্ন দেখাও থামছে না। আমার বিশ্বাস, যার জন্ম হয়েছে ২০০০ সালের পর, তার হাতে গিয়ে যদিএ গ্রন্থ পড়ে, সে ভাববে এটি তার সময়ের জন্য লেখা হয়েছে। যদি সময়ের পেছনে গিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে বেড়ে ওঠা কারও হাতে দেওয়া যেত ভবিষ্যতে লিখিত এ গ্রন্থ, তারও একই অনুভূতি হতো। এ গ্রন্থের শক্তি এতখানি।
আমার ঘরের দেয়ালের রং ছিল সাদা। ময়লা জমে জমে, এখন সাদা রং বোঝা দায়। ছোট ছোট টেনিস বলের অবয়ব এখানে-সেখানে ফুটে আছে। একপাশে ফুটবল আকৃতির একটা দাগ। আমি তো কোনোদিন খেলিনি এভাবে। আমার আগে এই ঘরে কোনো ছোট ছেলে থাকত? কতটুকু ছোট যে ফুটবলকে টেনিস বল ভেবে দেয়ালে ছুড়ে মারত? তার চেহারা কেমন ছিল? এখন কতটুকু বড় হয়েছে? নাকি, ছেলেটা আমিই ছিলাম? এখন হয়তো ভুলে গেছি। মানুষ কতকিছুই ভুলে যায়, এমন করে হয়তো নিজেকেও! এ রকম ভুলতে ভুলতে আমরা নিজেদের অস্তিত্ব ভুলে যাই, ভুলে যাই আমাদের শেকড়। বাস্তব ঘটনা মনে করিয়ে দিতে চাইলে এই আমরা দুটি কান হাত দিয়ে ঢেকে ফেলি। আমাদের সঙ্গে তাই হুমায়ুন আজাদের মতো কারও কারও রূপকের আশ্রয় নিতে হয়। মনে করিয়ে দিতে হয় আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা।
হুমায়ুন আজাদ মনে করিয়ে দিতে চান আমাদের সেই সময়ের কথা যখন পাকিস্তান আমাদের দখল করে রেখেছিল। ‘আমার বুকের ভেতর যারা ভয়ানক কৃষ্ণপক্ষ দিয়েছিল সেঁটে।’ আমরা ভেবে নিয়েছিলাম সেই সময়টাই স্বাভাবিক। লেখক আমাদের মনে করিয়ে দিতে চেয়েছেন সেই যাদুকরের কথা যার হাত ধরে আমরা স্বপ্ন দেখতে শুরু করে, স্বপ্ন বুকে নিয়ে লড়াইয়ের একটা ফলাফলও পেয়ে গিয়েছিলাম। সেই যাদুকর মানুষটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। গল্পটার কোথাও শেখ মুজিবের নাম নেই। গল্পটির কোথাও পাক বাহিনীর নাম নেই। তবু আপনি পড়ামাত্র বুঝে যাবেন, এবং হঠাৎ অনুভব করবেন আপনার শরীরের রোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। দেখবেন গল্পের শেষটায় এসে আপনার ওপর আত্মগ্লানি ভর করেছে।
হুমায়ুন আজাদের সাহিত্য আমাদের হারানো অতীতে যেমন নিয়ে যায়, তেমনই বর্তমানের রণক্ষেত্রেও ধরে রাখে। তাঁর শব্দ এমনই সময়চারী। ভাষা এমনই শক্তিদায়িনী। তিনি আমাদের যাদুকর। যাদুকরের মৃত্যু নেই। হুমায়ুন আজাদ [২৮ এপ্রিল ১৯৪৭–১২ আগস্ট ২০০৪]