।। আখতার সোবহান মাসরুর।।
জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে লেবার পার্টির সাবেক নেতা জেরেমি করবিন ও এমপি জারা সুলতানা ‘ইওর পার্টি’ নামে নতুন বামপন্থি রাজনৈতিক আন্দোলনের ঘোষণা দেন। এই অল্প সময়ে ৭ লক্ষাধিক মানুষ এর সদস্য হয়েছে। ডিসেম্বরে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর মধ্য দিয়ে দলের নাম ঠিক হবে। এই নতুন দলের কারণে প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের নেতৃত্বাধীন লেবার পার্টি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। নতুন দলের মূলনীতির মধ্যে রয়েছে শীর্ষ ধনীদের ওপর উচ্চ কর আরোপ; বিদ্যুৎ, পানি, রেল ও ডাক পরিষেবা রাষ্ট্রায়ত্ত করা। জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা রক্ষা ও বেসরকারীকরণ প্রতিরোধ। সামাজিক গৃহায়ন, পরিবেশ সুরক্ষা, সামাজিক ন্যায়বিচার ও সমতা প্রতিষ্ঠা করা। বিদেশনীতিতে নিরস্ত্রীকরণ ও যুদ্ধবিরোধিতা, ইসরায়েলের কাছে অস্ত্র বিক্রি বন্ধ ও স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পক্ষে অবস্থান।
২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে লেবার পার্টির পরাজয়ের পর নতুন নেতা কিয়ার স্টারমার করবিনসহ দলের ভেতরকার বামদের ওপর আঘাত হানেন। ব্রেক্সিট, ইহুদি বিদ্বেষের অভিযোগ ও নির্বাচনে পরাজয় বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালে জেরেমি করবিন লেবার পার্টির নেতৃত্ব থেকে সরে যান। উল্লেখ্য, করবিন ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর ইসরায়েল রাষ্ট্রের নিপীড়নের বিরুদ্ধে নিরন্তর কঠোর সমালোচক হওয়ায় জায়নবাদী লবি তাঁকে অ্যান্টিসেমেটিক ট্যাগ দেয়। স্টারমারের নেতৃত্বে লেবারপন্থিরা ডান দিকে ঝুঁকে পড়েছে।
নতুন দল ‘ইওর পার্টি’ গঠনের পর প্রাথমিক জরিপগুলো ইঙ্গিত দেয় যে, আগামী নির্বাচনে দলটি বেশ কিছু আসন পেতে পারে। নতুন দলের প্রধান ভোটার হবেন– হতাশ লেবার, পরিবেশবাদী গ্রিন পার্টির পুরোনো সমর্থক, নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী, যুবক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র; শহরের মুসলিম ও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী ঐতিহ্যগতভাবে লেবার পার্টির সমর্থক। আশাবাদীরা মনে করেন, শেষ পর্যন্ত জোট হলে পরবর্তী নির্বাচনে জোট ২০ থেকে ৩০টি আসন পেতে পারে, যা পার্লামেন্টে শক্তিশালী বাম ব্লক গড়ে তুলবে।
আরেকদিকে অতি ডানপন্থি নাইজেল ফারাজের দল রিফর্ম ইউকে দ্রুত শক্তি অর্জন করছে, যা কনজারভেটিভ পার্টির জন্য হুমকি হয়ে উঠছে। দীর্ঘ ১৪ বছর ক্ষমতায় থেকে টোরি দল (কনজারভেটি পার্টি) এখন অকার্যকর, বিভক্ত এবং জনবিচ্ছিন্ন। দেড় যুগ শাসনকালে (মে, জনসন, ট্রাস, সুনাক) কভিডের সময় সামাজিক মাধ্যমের নিয়ম ভঙ্গ, কৃচ্ছ্রনীতি, বেনিফিট কর্তন, ১০-১১ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দলটি ব্যাপক জনসমর্থন হারায়। ফারাজ জনতুষ্টিবাদী আবেগপ্রবণ ভাষায় সিস্টেমের বিরুদ্ধে কথা বলে পিছিয়ে পড়া মানুষদের কিছুটা আকৃষ্ট করতে পারছেন। টোরিকে ছাড়িয়ে ফারাজ হয়ে উঠছেন আসল ‘রক্ষণশীল কণ্ঠস্বর’। রিফর্ম ইউকের মূলনীতি হলো– কঠোর অভিবাসন বিরোধিতা, স্বাস্থ্যসেবা বেসরকারীকরণ, জলবায়ু নীতিতে নিট জিরো কার্বন নির্গমন টার্গেট বাতিল, সরকারি ব্যয় কমানো, কঠোর শাস্তি ও পুলিশে নিয়োগ বাড়ানো। এই সঙ্গে দলটি উগ্র জাতীয়তাবাদী ইউরোবিরোধী। আগামী নির্বাচনে রিফর্ম ইউকের কারণে টোরি ভোট ভাগ হয়ে পড়লে নির্বাচনী ক্যালকুলাস বদলেও যেতে পারে।
ব্রিটেনে বড় ধরনের বিপ্লবী আন্দোলন দেখা না দেওয়ার অন্যতম কারণ হলো ব্রিটিশ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কারের জন্য বেশ অনুকূল ও নমনীয়। মতাদর্শিক অন্ধত্ব ও অতি আবেগ ব্রিটিশ রাজনীতির বৈশিষ্ট্য নয়। সংস্কার ও ব্যবহারিক বাস্তববাদিতা (প্রাগমাটিজম) ব্রিটিশ রাজনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য। এ ছাড়া লেবার পার্টি বামপন্থাকে সব সময় গ্রাস করে রেখেছে। করবিনের নতুন দল লেবার পার্টির ছাতার নিচ থেকে বামপন্থাকে বের করতে পারলে স্বাধীন বামধারা তৈরি হতে পারে।
ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস ইংল্যান্ডে সমাজতন্ত্রের শান্তিপূর্ণ রূপান্তর সম্পর্কে বলেন, ‘ইংল্যান্ড একমাত্র দেশ যেখানে অনিবার্য সামাজিক বিপ্লব সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ ও আইনগত উপায়ে ঘটতে পারে।’ তবে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্তও জুড়ে দেন– ‘কিন্তু তখনই এটা সম্ভব, যদি ক্ষমতাসীন শ্রেণি এই শান্তিপূর্ণ ও আইনসম্মত বিপ্লবকে সম্মান করে।’ অর্থাৎ এঙ্গেলস মনে করতেন, তাত্ত্বিকভাবে ইংল্যান্ডে শান্তিপূর্ণ রূপান্তরের সুযোগ আছে। কারণ সেখানে সংসদীয় গণতন্ত্র, শ্রমিক শ্রেণির সংগঠন এবং রাজনৈতিক অধিকার বিদ্যমান। তিনি নিশ্চিত ছিলেন না, শাসক শ্রেণি এ রকম রূপান্তরকে সহ্য করবে। এঙ্গেলস কখনোই সংস্কারবাদে ভরসা করেননি।
ব্রিটিশ রাষ্ট্র প্রয়োজনে ভয়াবহ নিপীড়ক হয়ে উঠতে পারে। উপনিবেশিতদের অত্যাচার তো করেছেই, স্বদেশের ভেতরেও নিপীড়ন চালিয়েছে। দুনিয়াব্যাপী তথাকথিত লিবারেল রাজনীতি ব্যাপকভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এটি আসলে পুঁজিবাদের লিবারেল রূপেরই ব্যর্থতা। ব্রিটিশ রাজনীতিতেও লিবারেলিজম ব্যর্থ। এই প্রেক্ষাপটে জেরেমি করবিনের নতুন দল নতুন সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হয়েছে। নিউ লিবারেলকালে বৈষম্যের বিরোধিতা ও সমতা অর্জন, মানুষের অধিকার রক্ষা, যুদ্ধের বিরোধিতা, পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ, শান্তি ও পরিবেশ রক্ষায় বামপন্থার প্রয়োজন আরও জরুরি হয়ে উঠছে কেবল ব্রিটেনে নয়, বাংলাদেশের জন্যও বটে।
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা