।। আফজাল হোসেন ।।
বাঙালি দুঃখ পেতে ভালোবাসে, তাই সিনেমা, নাটক নভেল, গান- এসব উপভোগ্য করে তুলতে যত্ন করে অনেক দুঃখ ভরে দেয়া হয়।
সেই ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি, যে সিনেমা খুব কাঁদাতে পারে, সে সিনেমার নাম মহা আনন্দের খবর হয়ে মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। মানুষ বেশি দাম দিয়ে টিকিট কেটে হুড়মুড় হুলুস্থুল করে সে সিনেমা দেখতে যায়। ভাবা যায়, দুঃখ ভারাক্রান্ত হতে, কাঁদবার জন্য একই সিনেমা দর্শক অনেকবার দেখে। অনেককে পকেটের পয়সা খরচ করে দেখাতেও নিয়ে যায়। একেই বলে পয়সা দিয়ে দুঃখ কেনা।
আয়েশ করে দুঃখে চুমুক দিয়ে আনন্দ অনুভব করার একটা গল্প বলি। ছোটবেলায় একদিন বিকেলে, লুকিয়ে রাখা গুলতির জন্য আম্মার ঘরে ঢুকেছি। বাইরে তখন রোদ নরম হয়ে আসছে। আম্মা ঘরে পালঙ্কের উপর পা লম্বা করে, বালিশে হেলান দিয়ে বসে উপন্যাস পড়ছেন।
ঘরে আর কেউ নেই, দক্ষিন দিকের দুটো জানালাই খোলা। সে জানালা দিয়ে পাখির ডাক, ফুলের সুবাস, নরম রোদের গন্ধ ঘরে প্রবেশ প্রস্থানের খেলা খেলছে। লুকিয়ে রাখা গুলতি নিয়ে বেরিয়ে যাবার পথে দেখতে পাই- আম্মার চোখে অশ্রু, কাঁদছেন।
প্রথমে চমকে গিয়েছিলাম- একলা ঘরে বসে কাঁদছেন কেনো আম্মা! মানুষটা মস্ত সংসারের সবকিছু সামলে টামলে আধা ভেজা চুল চিরুনি দিয়ে কোনরকমে আঁচড়ে নিয়ে, এসময়টাতে অবসর উপভোগ করেন- বইয়ের পাতায় মুখর সময় কাটান। এমন একটা সময়ে কেনো কাঁদছেন তিনি?
খুব মেধাবী বা মনোযোগী ছাত্র ছিলাম না আমি কিন্তু অনেকের চোখে পড়ে না, এমন অনেককিছু আমার চোখে পড়তো, ভাবাতো আমাকে। যেমন সেদিন ঘরে বই পড়তে পড়তে, আম্মা কাঁদছেন দেখে ফেলি। তা ভাবায়, কেনো কাঁদছেন আম্মা?
আম্মাকে কাঁদতে দেখে গুলতি পকেটে পুরে, ডাকি- আম্মা!
চোখের পানি মুছে হাসেন আম্মা- কিছু হয়নি বাবা। হাতের বইটা তুলে দেখান।
কাগজের বই রক্তমাংসের মানুষকে কিভাবে কাঁদাতে পারে- তা বুঝতে আম্মার পড়ে শেষ করা বইটা লাইব্রেরিতে ফেরত দিতে গিয়ে গোপনে রেখে দেই। সেই অল্পবয়সে লুকিয়ে লুকিয়ে বড়দের জন্য লেখা উপন্যাস “রিক্তের বেদন” পড়ে কেঁদেকেটে বুক ভাসাই।
সময় বদলে গেলো। বড় হয়েছি। কলেজে ভর্তি হয়ে এর তার কাছ থেকে প্রায়ই শুনি- যে যুবক দেবদাস পড়েনি- সে যৌবনপ্রাপ্তই হয়নি। নিমাই ভট্টাচার্যের মেমসাহেব পড়া হয়নি যতদিন, ততদিন উঠতে বসতে শুনতে হয়েছে, আফজাল রে তোর জীবনই বৃথা।
জীবন বৃথা হয়নি। উপন্যাস, গল্প কবিতা, গান, সিনেমা নাটক- এ জীবনকে দিয়েছে অনেক। রাজনীতির ধোঁকা খেতে খেতে খেতে মনে হয়- ইহজীবনে এই ধোঁকা খাওয়া, দুঃখ শোক, মনোকষ্ট পাওয়ার দিন শেষ হবে না আমাদের।
হতাশাগ্রস্ত মনে মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে- আমাদের কী মস্ত কোনো অপরাধ আছে, যার কারণে সৃষ্টিকর্তা জগতেই পই পই করে সে অপরাধের শাস্তি ভোগ করিয়ে ছাড়ছেন! আবার এটাও মনে হয়-তিনি আমাদের প্রতি অত্যন্ত দয়াশীল, আমাদেরকে অশেষ ধৈর্যশক্তি ও দূর্ভোগ সহ্য করবার সাধ্য দান করেছেন।
গতকাল টেলিভিশনের খবরে শুনতে পেলাম, দেশ ও মানুষের উন্নতি চাওয়া মহান রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যের সকল ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে, আত্মীয়ের মতো মিলেমিশে সিলেটের ভোলাগন্জের সাদা পাথর গিলে খাওয়ার অসাধারণ পরিকল্পনা গ্রহন করেছিলেন।
সমবেত এ চুরি, ভোগের ঘটনা আমাদের জন্য বিশেষ এক প্রাপ্তি। আমরা দুঃখ পেতে ভালোবাসি, দুঃখ পাওয়ার ঘটনা আমরা পয়সা দিয়ে উপভোগ করতে দ্বিধা করি না। কি চমৎকার ভাগ্য আমাদের- এ রকম একটা দুঃখদায়ক ঘটনা আমরা নিখরচায় উপভোগ করতে পারলাম।
সাথে বোনাস হিসাবে একটা বিশেষ জ্ঞানলাভও হয়েছে- দেশ ও দশের ভালোর জন্য সকল রাজনৈতিক দল এক হতে পারুক বা না পারুক, ভোগের স্বার্থে সবাই প্রানখুলে এক হতে পারে।