গত বছরের ৫ই আগস্ট রাষ্ট্র ক্ষমতার পট-পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে দেশে ‘নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের’ সূচনা হয়েছে বলে দাবি ক্ষমতাসীনদের। কিন্তু ক্ষমতায় বসেই ক্ষমতার অপব্যবহার, প্রতিপক্ষের ওপর রাজনৈতিক প্রতিহিংসা-সহিংসতা, দখল ও চাঁদাবাজির মহোৎসব শুরু হয়ে যায়, যা ভবিষ্যতের জন্য অশনি সংকেত বলে মন্তব্য করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ক্ষমতাবলয়ের কাছাকাছি গোষ্ঠীগুলোর নাম উল্লেখ না করে বলেন, বিগত এক বছরে যারা সবচেয়ে প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে, তাদের নেতাকর্মীদের আচরণ ক্ষমতার অপব্যবহার, লুটপাট ও দুর্বৃত্তায়নেরই প্রতিচ্ছবি।
বিবৃতিতে বলা হয়, গণতন্ত্র ও সুশাসনের যে প্রত্যাশা নিয়ে মানুষ ‘নতুন বাংলাদেশ’-এর স্বপ্ন দেখেছিল, তার পরিবর্তে দেশজুড়ে দলবাজি, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, মামলা ও জামিন বাণিজ্য, ট্যাগ বাণিজ্যসহ সহিংস আধিপত্য বিস্তারের নতুন স্রোত শুরু হয়েছে। এতে রাজনৈতিক পরিবর্তনের ইতিবাচক সম্ভাবনা ধুলিসাৎ হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বিএনপি-জামায়াতের নাম এড়িয়ে গিয়ে টিআইবি আরও জানায়, অনেক ক্ষেত্রে এই নতুন পরিস্থিতিতে শুধু ক্ষমতাসীন বা ক্ষমতাপ্রত্যাশী নয়, অতীতে বিতর্কিত রাজনৈতিক শক্তিরাও যুক্ত হচ্ছে, ফলে রাজনৈতিক সহিংসতা ও অনিয়ম স্বাভাবিক রূপ নিতে চলেছে।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এবার আমাদের পালা’ এই মানসিকতা গণতান্ত্রিক বিকাশের পথে আত্মঘাতী প্রতিরোধ তৈরি করছে।
তিনি অভিযোগ করেন, রাজনৈতিক দলের উচ্চপর্যায়ের সতর্কতা ও কিছু সাংগঠনিক উদ্যোগ থাকা সত্ত্বেও তা বাস্তবে কার্যকর হচ্ছে না। বরং প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেকেই এসব অনিয়মে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করছে।
টিআইবির ভাষ্য মতে, রাজনৈতিক দলের ভেতরে জবাবদিহির অভাব, নৈতিক নেতৃত্বের সংকট ও দায়মুক্তির সংস্কৃতি রয়ে গেছে। ফলে ক্ষমতার অপব্যবহার ও সহিংস আধিপত্য বিস্তার ক্রমেই বাড়ছে। জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে দলের স্থানীয় নেতারা পরিবহন টার্মিনাল, বাজার, সেতু, খনিজ সম্পদ ও জলমহাল দখলসহ নানা চাঁদাবাজিতে যুক্ত হয়েছেন।
এ ছাড়া, ধর্মীয় রাজনৈতিক শক্তি ও অতিঅবস্থানকারী গোষ্ঠীর অংশগ্রহণে সংখ্যালঘু, নারী, আদিবাসী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার হরণের ঘটনাও ঘটছে বলে টিআইবি অভিযোগ করেছে। ‘মবতন্ত্র’-এর মাধ্যমে সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যবিরোধী সহিংসতা বাড়ছে বলেও বিবৃতিতে বলা হয়।
টিআইবি আক্ষেপ করে জানায়, সুশাসন ও স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গঠিত নতুন রাজনৈতিক দলগুলোর একটি অংশের নেতাকর্মীরাও ইতোমধ্যে চাঁদাবাজিসহ নানা অনৈতিক চর্চায় জড়িয়ে পড়েছেন, যা দুঃখজনক ও আত্মঘাতী পথ।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, যদি রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র, নৈতিকতা ও জবাবদিহিমূলক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়, তবে আকাঙ্ক্ষা চরম হতাশায় পর্যবসিত হবে।
গত এক বছরে দেশে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন বেড়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এছাড়াও চাঁদাবাজি, দখল, সহিংসতা এবং দলীয় প্রভাব বাড়ছে। রাজনৈতিক দলগুলো অভ্যন্তরীণ জবাবদিহিতা ও সংস্কার নিশ্চিতে ব্যর্থ হচ্ছে। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরও ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। জনগণের প্রত্যাশিত ‘নতুন বাংলাদেশ’ প্রপঞ্চ আদতে সংকটময় পথে এগোচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন তারা।