।।মাহবুব জামান।।
এক : বিভুরঞ্জন সরকার
অনলাইনে প্রথমে খবর পেলাম নিখোঁজ।অফিসে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। যে কোন কিছুই তো হতে পারে আজকাল।
পরে লাশ পাওয়া গেল নদীতে। সাথেই অনলাইনে ভেসে উঠলো বিভুর লেখা শেষ খোলা চিঠি।এ সময়ের এক নারকীয় বাস্তবতা উন্মোচিত হোল এই চিঠিতে। কিন্তু,এভাবে বিদায় নেয়া???
ওর সাথে ঠিক কবে পরিচয় মনে নেই।স্বাধীনতার পর পরকোন এক সময়।ঘনিষ্ঠতা পচাত্তরের দু:সহ দিনগুলোতে।
আরো ঘনিষ্ঠতা ‘যায় যায় দিন’-এর শুরু থেকে।তখন সাপ্তাহিক ছিল।প্রতি মঙ্গলবার বের হোত।অল্পদিনের মধ্যে দারুন জনপ্রিয়তা পেয়ে গেলো।
সারা সপ্তাহ সবাই যেন অপেক্ষায় থাকে তারিখ ইব্রাহিমের কলাম আর মিলা-মঈনের পরকিয়া কাহিনী ও গল্প পড়ার জন্য।
সেই তারিখ ইব্রাহিমই আমাদের বিভুরঞ্জন সরকার।

লেখার ধারে ও ভারে অল্প দিনের মধ্যে এটা হয়ে ওঠে আকর্ষণীয় রাজনৈতিক কলাম। সবাই পড়ার জন্য উন্মুখ।
‘যায় যায় দিন’ হয়ে ওঠে এরশাদ স্বৈরশাসকের চক্ষুশূল। কথায় কথায় ডাক পড়ে ক্যান্টনমেন্টে।কতবারতো নিষিদ্ধই হোল।একটা সাপ্তাহিক পত্রিকা এত বেশি সামাজিক-রাজনৈতিক প্রভাব ফেলতে পারে, এর আগে কেউ কোন দিন ভাবে নি।সে যেন এক অ্যাডভেঞ্চার! টান টান উত্তেজনা।
স্বৈরাচার শেষ, যায় যায় দিনের সেই উন্মাদনাও শেষ।এর পর বিভু অনেক ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে।
আমরা যৌথ ভাবে একটা উদ্যোগ নিয়ে ছিলাম ২০১২ সালে। বিজয় দিবস উপলক্ষে তিনদিন ব্যাপী বিজয় মেলা।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠে।
মেলার আর পুনরাবৃত্তি হয়নি তবে ‘বিজয় অন্ন’ টা রাফু আর প্রবালের কল্যাণে এখনও প্রতি বছর আয়োজন করা হয় গুলশানের এক রেস্তোরাঁয়।
প্রধানত: ডালে-চালে খিচুরি আর এর সাথে অনেক কিছু মিলিয়ে তৈরী হয় ‘বিজয় অন্ন’।
গত কয়েক বছর নিয়মিত যোগাযোগ ছিল না বিভুর সাথে।ওর শরীরটা খুব খারাপ গিয়েছে।
শেষ দেখা হোল মাস খানেক আগে ‘আমরা একাত্তর’ অফিসে।গণ মাধ্যমের আরো কয়েকজন ছিলেন। তাঁদের জগতের ‘অভাবনীয় স্বাধীনতা’ এবং ‘মন খুলে সমালোচনার’ উক্তি কি ভয়াবহ অবস্থায় আছেন,সেটা বোঝা গেল।
কিন্তু,সেজন্য এভাবে জীবন দিয়ে দেয়া।কিছুতেই মানতে পারছি না……….
দুই : সুলতান মাহমুদ শরীফ
আমি তখন ক্লাশ এইট/নাইনে পড়ি।আজিমপুর ওয়েস্ট এন্ড হাই স্কুলে। ১৯৬৪/৬৫ সাল হবে।
তখনকার দিনে প্রতি বছর টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে কয়েকজন শিক্ষক আসতেন আমাদের ৩/৪ মাস পড়াতে। ইন্টার্নশিপের মত। উনি আমাদের ভূগোল পড়াতেন।
তাঁদের পড়ানোর ভঙ্গি,স্মার্টনেস,পদ্ধতি খুব ভালো লাগতো।মাঝে মাঝে দেশ,দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়েও কথা বলতেন।তাছাড়া, তাঁর নামের মুন্সিয়ানাটাও আমার মনে ধরেছিল।
বহু দশক,বহু যুগ পর শুনলাম এই নামের একজন ইংল্যান্ডে আওয়ামী লীগের নেতা এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় দারুন কাজ করেছেন।
১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ারে যে অভাবনীয় সমাবেশ হয়েছিল তার অন্যতম সংগঠক ছিলেন তিনি। বাংলাদেশে গণহত্যার বিরুদ্ধে এই জাগরণে শুধু লন্ডন নয়, সারা ইংল্যান্ড থেকে ছুটে এসেছিলেন বাঙালী নর-নারী-শিশু।
অনেকদিন ইচ্ছা ছিল তাঁর সাথে দেখা করার।অবশেষে সুযোগ হোল ২০১৪ সালে।তখন বাংলাদেশের হাই কমিশনার মিজারুল কায়েস।আমরা আই টি সম্পর্কিত একটা এক্সপোতে গিয়েছিলাম।আয়োজন করা হয়েছে এক সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানের। ২৬ মার্চ অথবা ১৬ ডিসেম্বর।
বিশাল আয়োজন। অতিথি হিসাবে আমরা এবং আওয়ামী লীগ সভাপতি সুলতান মাহমুদ শরীফ।
স্বাভাবিক ভাবেই আমাকে চিনতে ওনার অসুবিধা হয়েছে।প্রায় ৫০ বছর আগের ঘটনা।

এরপর নিয়মিত যোগাযোগ ছিল।সবশেষ দেখা লন্ডনে ২০২৩ সালে ‘আমরা একাত্তর’-এর মত বিনিময় সভায়। আমরা তখন ১৯৭১ সালের জেনোসাইডের জাতি সংঘের স্বীকৃতির জন্য ইউরোপ, আমেরিকা,অস্ট্রেলিয়া এবং খোদ জাতিসংঘে প্রচার,সমাবেশ,মানব বন্ধন করে বেড়াচ্ছি।উনিও সহযোদ্ধা হয়ে গেলেন!
পরিকল্পনা হোল একাত্তরের ৪ এপ্রিলের মত ট্রাফালগার স্কয়ারে আবার একটা সমাবেশ করবো।
জেনোসাইডের স্বীকৃতির দাবীতে।গত শুক্রবার রাতে সত্যব্রত দাশ স্বপন খবর দিলো উনি হাসপাতালে। অবস্থা খুবই খারাপ।শনিবার উনি চলে গেলেন….
বিদায় প্রিয় যোদ্ধা,প্রিয় শিক্ষক……
তিন : দিনু বিল্লাহ
ভোরে নাসিরুদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর মেসেজ পেলাম ‘দিনু আর নাই’।
কোনভাবেই বিশ্বাস হচ্ছিল না।কি হোল? কি ভাবে হোল?
আমি এখন আমেরিকায়।ফোন করলাম লিনু বিল্লাহকে।ও বললো এখনও আই সি ইউ তে আছে দোয়া কর।মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ অর্থাৎ সেরেব্রাল হেমোরেজ।কাজেই আশা খুবই কম।
দিনু-লিনু আমার প্রাইমারি স্কুলের বন্ধু।কমলাপুরে ছিলাম।শৈশবের হাজারো স্মৃতি।
ওরা দুজনেই অলৌকিক ভাবে বেঁচে গিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়।গ্রেফতার হয়েছিল সুরকার আলতাফ মাহমুদের সাথে।আলতাফ ভাই ওদের দুলাভাই।
সৃজনশীল জীবনযুদ্ধ এবং অপরূপ,বৈচিত্র্যময় জীবন কাহিনী দিনুর।ওর লেখা “কাকা বাবুর টয় হাউজ” বইটা পড়ে আমি মুগ্ধ হয়েছি।দীর্ঘদিন ও অজিত গুহ স্যারের সান্নিধ্যে ছিল।সে এক আশ্চর্য অনুভব আর গড়ে ওঠার জীবন।
দীর্ঘদিন যাবত কানাডায় আছে।বহু বছর পর ২০২২-এ কানাডায় দেখা হোল।তাও আমাদের ঢাকার প্রতিবেশী মিলির ছোট ভাই মিঠুর প্রতিবেশী হিসাবে অল্পক্ষণের দেখা।খুব বেশি কথা হয় নি।
এরপর থেকে ম্যাসেঞ্জারে যোগাযোগ ছিল নিয়মিত।
গতমাসে আমি কানাডা এলাম। লিনু আমাকে দুইটা বই আর একটা ক্রেস্ট দিয়ে দিল দিনুর জন্য।
কানাডা পৌঁছে পরের দিনই গেলাম মিঠুর বাসায়।খালাম্মা-খালুজান ওখানেই থাকেন।
কিন্তু, দুর্ভাগ্য আমার।দিনু গিয়েছিল টরোন্টো আরেক কাজে।দেখা হোল না।টেলিফোনে কথা হোল এবং ঠিক হোল যে আমি যখন আমেরিকা থেকে কানাডা ফিরবো তখন অনেক কথা হবে।
ওর প্রচন্ড আগ্রহ ছিল ‘আমরা একাত্তর’ নিয়ে।ও যুক্ত হবে এই সব কর্মকান্ডে।
কিন্তু,কিছুই হোল না। ও চলে গেল অনন্তলোকে।
বৈচিত্র্যময় দিনু যাবার পরও রেখে গেছে বিস্ময় !
দিনু দেহ ও সকল অঙ্গ প্রতঙ্গ দান করে গিয়েছিল।এই মাত্র অনলাইনে খবর পেলাম ওর ফুসফুস , কিডনী,লিভার সহ ওর টিস্যু ব্যবহার করে ইতিমধ্যেই ওন্টারিও রাজ্যের ৭৯ জন রোগী উপকৃত হয়েছে।
দিনু,প্রিয় বাল্য বন্ধু আমার,তুমি চলে গিয়েও রেখে গেলে বিস্ময়!

এমন এক সময়ে পরপর তিন দিনে তিন প্রিয়জনকে আমরা হারালাম,যখন মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করেছে হায়নারা।
মুছে দিতে চাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের সব স্মৃতি চিহ্ন।কিন্তু,ওরা কিভাবে মুক্তিযুদ্ধকে মুছে দিবে আমাদের হৃদয় থেকে? আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের হৃদয় থেকে? কিভাবে উধাও করে দেবে সারা দেশব্যাপী হাজার হাজার বধ্যভূমি?
এরা তিনজনই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা।
মুক্তিযুদ্ধ হারিয়ে যাবার নয়।একাত্তর চিরঞ্জীব।
জয় বাংলা !!!