গত ২৮শে আগস্ট ‘মঞ্চ ৭১’ নামে নতুন একটি সংগঠন ঢাকায় “আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের সংবিধান” শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সংবিধানের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনার জন্য আয়োজিত এ সভায় মুক্তিযোদ্ধা, আইনজীবী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংবাদিক, শ্রমিকনেতা ও সামাজিক কর্মীরা অংশ নেন।
শান্তিপূর্ণভাবে চলতে থাকা আলোচনাটি হঠাৎই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী সশস্ত্র একটি দল হামলা চালিয়ে ভণ্ডুল করে দেয়। হামলাকারীরা নিজেদেরকে ‘জুলাই যোদ্ধা’ পরিচয় দিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষকসহ উপস্থিত বুদ্ধিজীবীদের শারীরিকভাবে আঘাত করে এবং অকথ্য স্লোগান দেয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা এ ঘটনাকে গণতন্ত্র ও নাগরিক অধিকারের জন্য ভয়াবহ হুমকি হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
কিন্তু হামলাকারীদের গ্রেপ্তার না করে পুলিশ উল্টো ওই আলোচনায় উপস্থিত ১৬ জন বিশিষ্ট নাগরিককে আটক করে ডিবি অফিসে নিয়ে যায়। পরে তাঁদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা দায়ের করা হয়।
এতে ক্ষোভ প্রকাশ করে নাগরিক সমাজ বলছে, শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ সাংবিধানিক অধিকার, আর হামলা সুস্পষ্ট অপরাধ। অথচ হামলাকারীদের ছাড় দিয়ে অংশগ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের অন্যায় ও আইনের শাসনের পরিপন্থী।
বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধা, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী ও প্রবাসী নাগরিকেরা এক যৌথ বিবৃতিতে এ ঘটনার নিন্দা জানান।
তাঁরা বলেন, শান্তিপূর্ণ আলোচনা অপরাধ নয়, বরং গণতান্ত্রিক অধিকার। এমন আয়োজনকে অপরাধী কর্মকাণ্ড হিসেবে চিহ্নিত করা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি চরম অবমাননা।
বিবৃতিতে আটক নাগরিকদের অবিলম্বে মুক্তি, মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার এবং হামলাকারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানানো হয়।
বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, সুইডেন, নরওয়ে, জার্মানি, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশে বসবাসরত মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক, সাংবাদিক, সামাজিক কর্মী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা।
তাঁদের মধ্যে আছেন- যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মুক্তিযোদ্ধা, শিল্পী ও চিত্রশিল্পী তাজুল ইমাম; বোস্টন, যুক্তরাষ্ট্রের মুক্তিযোদ্ধা ও প্রকৌশলী ইউসুফ চৌধুরী; সুইডেনের উপসালার আদালতের বিচারক মুক্তিযোদ্ধা আকতার জামান; ফ্লোরিডা, যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধা ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ শামীম মৃধা; ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্রের মুক্তিযোদ্ধা ও চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট কাজী আই. ইকবাল; এবং ফ্লোরিডাভিত্তিক আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী পারভেজ হাশেম।
তাঁদের সঙ্গে রয়েছেন সুইস পাবলিক রেডিওর জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক শার্লট জ্যাকেমার্ট, নরওয়ের হাউকেল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের উপদেষ্টা মো. সাদিক হাসান, বার্গেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইশতিয়াক জামিল, হাউকেল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের গবেষক আমিনুর রহমান, সুইডেনের উপসালা সিটি কাউন্সিলের সাবেক শিক্ষক শেলিনা আফরোজ জামান, জার্মানির সমাজকর্মী তনয় ইমরোজ আলম, সুইডেনের গ্লোবাল জাস্টিস নেটওয়ার্ক ফাউন্ডেশনের সদস্য সাইফুর রহমান মিশু, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক লেখক ও সাংবাদিক মিনহাজ আহমেদ, কানাডার অন্টারিওতে বিজ্ঞানী রেজাউল কবির বাদল, সিনিয়র সাংবাদিক ও বিশ্লেষক তৌফিক মারুফ এবং যুক্তরাষ্ট্রের সংগঠক ও গায়ক আল আমিন বাবু।
এছাড়াও স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে আছেন যুক্তরাষ্ট্রের সমাজকর্মী নাহিদা নাসের, সুইডেনের সমাজকর্মী নাহার মমতাজ, ফ্রান্সের ভাস্কর শোহেলা পুরবিন শোভা, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কবি তুহিন দাস, নেদারল্যান্ডসের র্যাপিড সিকিউরিটি সার্ভিসেস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুরাদ খান, নরওয়ের বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক বিদ্যুত কাল, বাংলাদেশের সমাজকর্মী আদিবা জাহান এবং ব্লগার ও মানবাধিকারকর্মী লিয়াকত হোসেন লিমন ও ভায়োলেট হালদার, সম্পাদক ও প্রকাশক, সময়ের শব্দ, নরওয়ে
বিবৃতির শেষে তাঁরা সরকারের প্রতি আহ্বান জানান যে, মুক্তিযোদ্ধা, বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ নাগরিকদের অবৈধ হামলার মাধ্যমে যেন হেয় বা চুপ করিয়ে দেওয়া না হয়। গণতান্ত্রিক পরিসর, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচার রক্ষা করা কেবল সাংবিধানিক দায়িত্ব নয়, বরং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভিত্তিতে রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্বও বটে।