দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যখন অস্থির হয়ে ওঠে, তখন সবচেয়ে বড় মূল্য দিতে হয় সাধারণ মানুষকে। আজকের বাংলাদেশে আমরা সেই চিত্রই দেখতে পাচ্ছি। একদিকে রাজনৈতিক উত্তেজনা, অন্যদিকে অর্থনীতির নাজুক অবস্থা। এই দুইয়ের মিশ্রণে তৈরি হয়েছে এমন এক পরিস্থিতি যা দেশের ভবিষ্যতের জন্য গভীর উদ্বেগের কারণ।
গত কয়েক মাসে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতা, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংঘাত এবং সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের ঘটনাগুলো যেন একটি বার্তাই দিচ্ছে – রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এখনও অধরা। এই অস্থিরতার সবচেয়ে বড় শিকার হচ্ছে দেশের অর্থনীতি, আর তার প্রভাব পড়ছে কোটি কোটি সাধারণ মানুষের জীবনে।
অর্থনীতিবিদরা বরাবরই বলে আসছেন যে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সেই স্থিতিশীলতা কোথায়? যখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ১৪৪ ধারা জারি করতে হয়, যখন রাজনৈতিক নেতাদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে, তখন বিনিয়োগকারীরা কী করে আস্থা রাখবেন?
বাস্তবতা হলো, বিনিয়োগকারীরা এখন অপেক্ষার নীতি নিয়েছেন। তারা দেখতে চান রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোন দিকে যায়। এই অনিশ্চয়তার কারণে নতুন প্রকল্প শুরু হচ্ছে না, পুরোনো প্রকল্পগুলোও ঝুঁকির মুখে। ফলে কমে যাচ্ছে চাকরির সুযোগ, বাড়ছে বেকারত্ব।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ৩.৯৭ শতাংশে। এটি গত দুই দশকে করোনাকাল ছাড়া সর্বনিম্ন। এই পরিসংখ্যানটি শুধু একটি সংখ্যা নয়, এটি লাখো মানুষের জীবনযাত্রার মানের সাথে জড়িত। প্রবৃদ্ধি কমে গেলে কমে যায় কর্মসংস্থান, কমে যায় আয়, বাড়ে দারিদ্র্য।
আরও গভীর উদ্বেগের বিষয় হলো, সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে যে প্রশ্ন উঠছে তা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিস্বরূপ। কাকরাইলের ঘটনায় সেনাবাহিনীর সরাসরি হস্তক্ষেপ এবং বেসামরিক নেতাদের ওপর লাঠিপেটার ঘটনা দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। একটি দেশে যখন সেনাবাহিনী রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানে সরাসরি নেমে পড়ে, তখন সেই দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়। জুন শেষে এই প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ৬.৪ শতাংশ। এর মানে হলো, ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে নতুন বিনিয়োগে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। তারা রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ঝুঁকি নিতে চাইছেন না।
বিষয়টি আরও গভীর হয় যখন আমরা দেখি যে, মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে প্রায় ১৯ শতাংশ। এর মানে হলো, শিল্পপতিরা নতুন যন্ত্রপাতি কিনছেন না, কারখানার আধুনিকায়ন বন্ধ হয়ে গেছে। দীর্ঘমেয়াদে এটি দেশের উৎপাদনশীলতা কমিয়ে দেবে।
সবচেয়ে হৃদয়বিদারক তথ্য হলো দারিদ্র্যের বিস্তার। পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের গবেষণা বলছে, দেশের ৩৮ শতাংশ শ্রমশক্তি এখন আংশিক কর্মসংস্থানে যুক্ত। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছর আরও ৩০ লাখ মানুষ অতি দরিদ্র হবে। মানে দেশে অতি দারিদ্র্যের হার বেড়ে ৯.৩ শতাংশে পৌঁছাবে।
এই পরিস্থিতির মূল দায় কিন্তু বর্তমান নেতৃত্বের ওপরই বর্তায়। এক বছর ক্ষমতায় থেকেও তারা দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনতে পারেনি। বরং প্রতিদিনই নতুন নতুন সংকটের জন্ম দিচ্ছে। যে সরকার নিজেকে ‘সংস্কারক’ বলে দাবি করে, সেই সরকারের আমলেই দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দুই দশকের সর্বনিম্নে নেমেছে।
এই পরিসংখ্যানগুলোর পেছনে রয়েছে লাখো পরিবারের দুর্দশা। যে বাবা কয়েক মাস ধরে চাকরি খুঁজে পাচ্ছেন না, যে মা সন্তানের দুধের টাকা জোগাড় করতে পারছেন না, যে তরুণ স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়েছিল কিন্তু কোথাও সুযোগ পাচ্ছে না – তাদের কথা ভেবে দেখুন।
রাজনৈতিক দলগুলো যখন নিজেদের মধ্যে লড়াইয়ে ব্যস্ত, তখন এই সাধারণ মানুষের কথা কে ভাবে? যখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অশান্তি চলে, তখন শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হয়। আর শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হলে ভবিষ্যত প্রজন্মের ক্ষতি হয়।
অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব দাবি করছে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। অদৃশ্য এই সব আলাপ কাগজে-কলমে দেখতেই কেবল ভালো লাগে। কিন্তু মূল সমস্যা হলো, এক বছরেও এই সরকার একটি স্পষ্ট অর্থনৈতিক দিকনির্দেশনা দিতে পারেনি। প্রধান উপদেষ্টার অর্থনৈতিক পরিকল্পনা কী? কোন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেশ পরিচালনা করছেন? এই মৌলিক প্রশ্নগুলোর উত্তর এখনও অস্পষ্ট।
সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হলো রাজনৈতিক সংলাপের ক্ষেত্রে। যেখানে দেশের অর্থনীতি হুমকির মুখে, সেখানে নেতৃত্ব রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে কার্যকর সংলাপ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। কাকরাইলের ঘটনার পর বিচার বিভাগীয় তদন্তের ঘোষণা দিয়ে আপাতত সময় কেনার চেষ্টা করা হচ্ছে, কিন্তু মূল সমস্যার সমাধান কোথায়?
আগামী নির্বাচনের কথা বলা হচ্ছে ফেব্রুয়ারিতে। নির্বাচন কমিশন একে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ নির্বাচন বলেছে। এই ঝুঁকি শুধু নির্বাচনী প্রক্রিয়ার জন্য নয়, পুরো দেশের অর্থনীতির জন্যও। যদি নির্বাচনের আগে বা পরে সহিংসতা হয়, তাহলে বিদেশি ক্রেতারা অর্ডার বাতিল করবে, বিনিয়োগকারীরা আরও সতর্ক হয়ে যাবে।
রফতানিমুখী শিল্পগুলো বিশেষভাবে চিন্তিত। তৈরি পোশাক শিল্প, যেটি দেশের রফতানি আয়ের সবচেয়ে বড় অংশ, সেখানে ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। তারা রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অর্ডার দেওয়ায় সতর্ক হয়ে পড়েছেন।
শেয়ারবাজারেও এই অনিশ্চয়তার প্রভাব পড়েছে। অনেক কোম্পানি গত বছর লভ্যাংশ দিতে পারেনি। বিনিয়োগকারীরা নতুন বিনিয়োগে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।
এই পরিস্থিতির সমাধান কী?
সবার আগে ইউনুস-খলিল গংয়ের দখলদার অবৈধ সরকারকে বুঝতে হবে যে, তাদের প্রতিটি কাজ দেশের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলে। যখন তারা সংঘাতের পথ বেছে নেন, তখন হাজারো পরিবারে অভাব নেমে আসে। যখন তারা অস্থিরতা সৃষ্টি করেন, তখন বেকারত্ব বাড়ে।
দেশের ব্যবসায়ীরা এখন একটি স্থিতিশীল সরকারের অপেক্ষায়। তারা বিনিয়োগ করতে চান, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে চান। কিন্তু রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে তারা পারছেন না।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেনের কথায়, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা যত বাড়বে, বিনিয়োগকারীদের আস্থা তত কমবে। এই আস্থার অভাবে রফতানি, আমদানি, এমনকি ব্যাংকিং খাতও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের মোস্তাফিজুর রহমান সঠিকই বলেছেন, বিনিয়োগ চাঙা করতে হলে একটি ভালো নির্বাচন দরকার। বিনিয়োগকারীরা একটি স্থিতিশীল সরকারের নিশ্চয়তা চায়।
এখন সময় এসেছে সবার একসাথে ভাবার। ইউনুস-খলিলকে বুঝতে হবে যে, তাদের দায়বদ্ধতা শুধু ক্ষমতা দখল নয়, দেশের মানুষের কল্যাণও। অর্থনীতির এই নাজুক অবস্থায় আর কোনো অস্থিরতার সুযোগ নেই।
দেশের ভবিষ্যত নির্ভর করছে আগামী কয়েক মাসের রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর। যদি সহিংসতা ও অস্থিরতা অব্যাহত থাকে, তাহলে আরও গভীর সংকটের দিকে যেতে হবে। কারণ অর্থনীতির এই ক্ষত সারাতে সময় লাগবে, কিন্তু আরও ক্ষত সৃষ্টি করতে সময় লাগে না।