।। হামিদ মোহাম্মদ।।
বাংলাদেশ এক আজব দেশ। দেশটি আজব নয়, মূলত দেশের মানুষ। মাদ্রাসা শিক্ষা কেন যেন সাধারণ শিক্ষার প্রতিপক্ষ ভাবা হয়,তাও মাদ্রাসায় পড়ুয়ারা এটি ভেবে থাকে বা এরকম ভাবনায় গড়ে তোলা হয়। সাধারণ মানুষ কিন্তু এধরনের কিন্তু চিন্তা-চেতনার ধারেকাছেও নেই। তবুও এই ধারণাই বিদ্যমান। যদিও্ এই সাধারণ মানুষই মাদ্রাসাগুলো গড়ে তোলেন বা পৃষ্টপোশকতা করেন। তারা সাধারণ শিক্ষাকে প্রতিপক্ষ ভাবনার এমন ধারণাকে পৃষ্টপোশকতা করেন না, করেন ইসলামিক শিক্ষাকে।
যদি সাধারণ মানুষ এ ধরণের ভাবনার বাইরে,তবু কেন এমন হয়?এর উত্তর খুঁজতে হলে ইতিহাস ঘেটে দেখা জরুরি। ‘দেশের জনসংখ্যা হচ্ছে ১৭ কোটি।সেই দেশের কওমী মাদ্রাসার সংখ্যা হচ্ছে ১৯ হাজার ১৯৯ টি।এর মধ্যে প্রায় এক হাজার মাদ্রাসা হচ্ছে হেফাজত নিয়ন্ত্রিত। বাংলাদেশে এমপিও ভুক্ত মাদ্রাসার সংখ্যা হচ্ছে ৭ হাজার ৬২৪ টি। এছাড়াও প্রায় দুই হাজার অনিবন্ধিত মাদ্রাসা আছে। বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে তিন লাখ মসজিদ রয়েছে, অথচ বাংলাদেশ থেকে তুরস্ক প্রায় পাঁচ গুণ ও ২১ গুণ বড় ইরানেও এত মসজিদ নাই।এমনকি যেখানে থেকে ইসলামের আমদানি হয়েছে সেই সৌদি আরবেও আপনি এত মসজিদ খুঁজে পাবেন না।
১৮৬৬ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের সাহারানপুর জেলায় ‘ দারুল উলুম দেওবন্দ ” নামে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছিলো ব্রিটিশরা। ব্রিটিশরা কোনকালেই নাকি মুসলমানদের বন্ধু ছিলো না ।তাহলে ব্রিটিশরা ভারতীয় উপমহাদেশে মাদ্রাসা শিক্ষার প্রসার করলো কেন? পৃথিবীর প্রথম কওমী মাদ্রাসার উৎপত্তি হচ্ছে ভারতে। এর আগে পৃথিবীর কোথাও কোন কওমী মাদ্রাসা ছিলো না।১৭৮০ সালে ব্রিটিশ গভর্ণর লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস সর্বপ্রথম ভারতের কলকাতায় আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত করেছেন।এর আগে পৃথিবীর কোথাও কোন আলিয়া মাদ্রাসা ছিলো না। এই কওমী মাদ্রাসা ও আলিয়া মাদ্রাসা কোনটাই পৃথিবীর কোন মুসলিম দেশ থেকে আসেনি, এই দুটোর কারিগর হচ্ছে ব্রিটিশ।এখন দেখছি পৃথিবীতে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় বন্ধু হচ্ছে ব্রিটিশরা। এমনকি মাওলানা ওহাবকে দিয়ে সৌদিআরবে ওহাবি মতবাদ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত করেছে ব্রিটিশরা।এর মাধ্যমে তারা আরব বিশ্বকে কয়েক টুকরো করে ফেলেছে। তুর্কি সাম্রাজ্য ভেঙ্গে খান খান করে দিয়েছে।এই ওহাবীবাদ থেকেই মুলত আজকের জামায়াত, হেফাজত, আইএস, আল কায়েদা, তালেবান ও শত শত ইসলামিক জঙ্গীদের সৃষ্টি। বর্তমান বিশ্বে জঙ্গীবাদের অন্যতম মদদদাতা হচ্ছে ব্রিটিশ ও আমেরিকা। এজন্য হেফাজত ও জামায়াত জন্মের পর থেকেই ব্রিটিশ ও আমেরিকার গোলামীর নামে একের পর এক জঙ্গী সংগঠন পয়দা করছে। মাদ্রাসা শিক্ষার নামে কোমলমতি শিশুদের মগজ ধোলাই করে তাদের জঙ্গী করে গড়ে তোলা হচ্ছে।এমনকি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত রেডিক্যাল অ্যাপহরিজম ছড়িয়ে মানুষকে মানুষ হত্যার জঙ্গীবাদে জড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এর পেছনে আছে হেফাজত ও জামায়াতের পেছনে আমেরিকার বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ।কখনো নিজেকে প্রশ্ন করেছেন, মাত্র ৫৬ হাজার বর্গমাইলের ছোট্ট এই দেশে ৪০ টা জঙ্গী সংগঠন ও শতাধিক ইসলামিক রাজনৈতিক দল কেন? প্লিজ, এখন থেকে নিজেদের প্রশ্ন করুন।’
প্রশ্নের উত্তরে আমরা পাই এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয় না, জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয় না। কোনো ব্যবস্থাও নেওয়া হয় না। ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয় না। রাষ্ট্রের ভেতরে রাষ্ট্র।এই কেমন দেশ?
আরো প্রশ্ন-সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সঙ্গীত শিক্ষক রাখা যাবে না,এটাও এই অপরাষ্ট্রের দাবী। এদিকে, রাজবাড়ি জেলার গোয়ালনন্দ এলাকায় নূরাল পাগলা নামে এক বাউল মারা গেছে। তার কবর সামান্য উচু করে দিয়েছেন তার শিষ্য বা স্বজনরা। এতেই অপরাধ! লাশ কবর থেকে তুলে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এরা নাকি তৌহিদী বা বিক্ষুদ্ধ জনতা। এই বিক্ষুদ্ধ জনতা আবার বেশির ভাগ মাদ্রাসা পড়ুয়া।
এদের উদর থেকে বেড়ে ওঠা ছানারা এখন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ মানে না। এটা নাকি ভারতীয় ষড়যন্ত্র ছিল। একটা সুন্দর ইসলমিক দেশকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। দুই ভায়ের ঝগড়াকে কাজে লাগিয়ে এমন ঘটনা ঘটিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমন বয়ান তৈরী হয়েছে উপরে বর্ণিত বিভিন্ন উগ্রবাদী সংগঠনের তরফ থেকে এবং তাদের সাঙ্গপাঙ্গদের মুখ দিয়ে প্রকাশ করা হচ্ছে।
শেষ প্রশ্নে উত্তর হবে এটা- আমরা কি করে এসব মেনে নিই। আমাদের পোষা মাদ্রাসা বা মাদ্রাসা শিক্ষা তো আমদের সন্তানদের সুসন্তান করে গড়ে তোলার বিবেচনা থেকে আমরা মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাকে লালনপালন করি। কিন্তু শত্রু হিসাবে তৈরী করার কোনো ফন্দি থেকে তো নয়? তবে কেন শত্রু হিসাবে তৈরী হচ্ছে আমার সন্তান আমাদেরই ঘরে?
বিস্ময়ের ব্যাপার, সেই যে উপনিবেশিক মনোভাব। ‘মননে উপনিবেশিকতা’ একটি গবেষণা নিবন্ধ পড়েছিলাম ক’বছর আগে। লিখেছিলেন সাহিত্যগবেষক মফিদুল হক। আমাদের মগজে ব্রিটিশ উপনিবেশিক শক্তি উপমহাদেশে মাইনের মতো পুঁতে রেখে গিয়েছে ‘উপনিবেশিক মনন’। আমরা সেই ‘মনন’ থেকে বিষ্ফোরিত হওয়া অদৃশ্য বোমায় ক্ষতবিক্ষত ও মারামারি করছি।
এখানে উল্লেখ প্রয়োজন, ১৭৫৭ সালের পর উপমহাদেশে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমল ছিল মোগল শাসনের অধীনে, তাও ১৮৫৮ সাল পর্যন্ত। তখন ফার্সী ছিল রাষ্ট্রভাষা উপমহাদেশে। এতে ইংরেজরা বা দেশীয়রা ফার্সী ভাষা না-শিখলে ভারতীয় উপমহাদেশে অফিসিয়াল কাজকর্ম করা দুরূহ ছিল। এই প্রেক্ষিতে সমগ্র ভারতে বেশ কয়েকটি মাদ্রাসা ফার্সী ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে গড়ে তোলা ছিল আবশ্যিক। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইংরেজ বা এদেশীয় হিন্দু-মুসলিম সব সম্প্রদায় লেখাপড়া করতেন।পরে ১৮৭২ সালে ব্রিটিশরাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পরিবর্তে ভারতকে সরাসরি ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থায় নিয়ে এলে উপমহাদেশে নানা যুগান্তকারি পরিবর্তন আসে।১৮৮৪ সালে ভারতে ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষা ব্যবস্থা শুরু করা হয়। কলকাতায় প্রথম ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নয়া যুগের প্রবর্তন হয়।ধীরে ধীরে সমগ্র উপমহাদেশে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থার রূপান্তর ঘটে।অফিসিয়াল কাজকর্ম ইংরেজি ভাষায় সম্পন্ন করার বিধান হয়।তখন রাষ্ট্রের প্রয়োজনে আর দরকার হয়নি মাদ্রাসায় ফার্সী ভাষা শিক্ষা বা প্রয়োজন ফুরিয়ে যায় মাদ্রাসা শিক্ষারও।
রাষ্ট্র চলবে যে ভাষায় সে ভাষাই তো শিক্ষার বাহন হওয়া প্রথম শর্ত। ব্রিটিশ উপনিবেশ নেই, পাকিস্তানী অপরাষ্ট্র থেকে যুদ্ধ করে স্বাধীন হলাম, রাষ্ট্রভাষা এখন ‘বাংলা’। বৈশ্বয়িক কারণে আমরা আর ফার্সী ভাষার ওপর নির্ভরশীল নই, রাষ্ট্র ভাষা ফার্সী নয়, তবে কেন মোগল আমলের ফার্সী, পাকিস্তানী উর্দু এবং আরবী কী প্রয়োজনে শিখবো, শেখাবো সন্তানদের?
এসব ভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করা সন্তানরা তো অফিসিয়ালি রাষ্ট্রের কোনো যন্ত্রে কাজ করতে পারেব না। অবলীলায়, কাজ করার যোগ্যতা অর্জন করা থেকে বঞ্চিত হয়ে গেল্।মাদ্রাসা শিক্ষার প্রচলন বা পৃষ্টপোষকতা করে জেনেশুনে, বুঝেসুজে নিজের পায়ে কুড়াল মারছি শুধু নয়, সমগ্র জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত করে আসছি।
শুধুমাত্র যদি ইসলামিক শিক্ষার প্রয়োজন হয়, বা প্রয়োজন ধরে নিলাম, তবে মসজিদকেন্দ্রিক মক্তব এবং সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় বিদ্যমান ধর্মীয় শিক্ষার বিধানটি বহাল রাখলেই তো হয়।
আসুন, ‘রাষ্ট্রের ভেতর রাষ্ট্র’ নিয়ে ভেবে দেখি জাতিগত ভালোবাসার জায়গাটি মানবিক করে তুলি, এক ভাষায় এক চিন্তাচেতনায় একে অন্যকে ভালোবাসি। কবর থেকে তুলে লাশ পোড়ানোর মগজ থেকে বেরিয়ে আসা জরুরি ভাবা এখন কার কাছে কই!