বাংলাদেশের ইতিহাসে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য সর্বদা জাতির অন্তরে গভীরভাবে প্রোথিত। পীর–আউলিয়া, গাউস–কুতুব ও ওলীদের মাজার শুধু ধর্মীয় কেন্দ্র নয়, বরং সামাজিক মিলনস্থলও বটে। শত শত বছর ধরে এসব স্থান মানুষের আত্মিক চর্চা, সাম্য ও মানবতার শিক্ষার প্রধান উৎস হয়ে আছে। অথচ সাম্প্রতিককালে দেশজুড়ে যে বর্বর তাণ্ডব চালানো হচ্ছে, তা আমাদের সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক ইতিহাসকে ধ্বংস করার এক নৃশংস অপচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়।
গোয়ালন্দের ঘটনা চরম উন্মত্ততার দৃষ্টান্ত
স্থানীয় সূত্র জানাচ্ছে, গোয়ালন্দ উপজেলা ইমাম পরিষদের সভাপতি ও থানা জামায়াতের সভাপতি মৌলানা জালাল প্রায় ১৫–২০ দিন আগে ‘ঈমান ও আকিদা রক্ষা কমিটি’ নামের একটি সংগঠন গঠন করেন। প্রথম দেখায় সংগঠনের নামটি ধর্মীয় আবেগ জাগ্রত করার মতো হলেও বাস্তবে এটি ছিল চরমপন্থী গোষ্ঠীকে সংঘবদ্ধ করার একটি হাতিয়ার।
এরই ধারাবাহিকতায় পৌর বিএনপি’র সভাপতি আবুল কাশেম এবং গোয়ালন্দ থানা বিএনপি’র জয়েন্ট জেনারেল সেক্রেটারি আয়ুব আলী খানের প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে গতকাল সংঘটিত হয় এক ভয়াবহ নৃশংসতা। তারা অনুসারীদের নিয়ে একটি পবিত্র মাজার ভেঙে ফেলে, এমনকি কবর থেকে লাশ তুলে উন্মত্ত উল্লাসে লাশ পোড়ানোর মতো মধ্যযুগীয় বর্বরতা প্রদর্শন করে। এই দৃশ্য শুধু স্থানীয় মানুষকে নয়, সমগ্র জাতিকে স্তম্ভিত করেছে।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বারবার ফিরে আসা একই চিত্র
এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বাংলাদেশের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, যখনই জামায়াত–বিএনপি কিংবা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী গোষ্ঠী রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছে অথবা প্রভাব বিস্তার করেছে, তখনই ধর্মীয় আচার–অনুষ্ঠান, আধ্যাত্মিক কেন্দ্র এবং মাজারের ওপর নৃশংস আঘাত নেমে এসেছে।
পাকিস্তান আমলে (১৯৪৭–৭১) তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সুফিবাদ ও মাজারভিত্তিক সংস্কৃতিকে ইসলামবিরোধী আখ্যা দিয়ে দমন করার চেষ্টা চালায়। মাদ্রাসাভিত্তিক কঠোর মতাদর্শ প্রচারের মাধ্যমে তারা বাঙালি মুসলমানদের আধ্যাত্মিক চেতনা ক্ষুণ্ন করতে চেয়েছিল।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রাজাকার–আলবদর বাহিনী বহু মাজার ও দরগাহে হামলা চালায়, কারণ এগুলো ছিল মুক্তিকামী মানুষের মিলনস্থল। অনেক পীর–মাশায়েখ মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে দাঁড়ানোয় তাদেরও হত্যা করা হয়।
২০০১ সালে বিএনপি–জামায়াত সরকার গঠনের পর : সারা দেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পাশাপাশি বহু পীর–আউলিয়ার মাজার ও আশ্রমে হামলা হয়। সন্ত্রাসীরা পীর–দরবেশদের হত্যার ঘটনাও ঘটায়। ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা ছিল ধর্মীয় উগ্রবাদী ও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের যৌথ বহিঃপ্রকাশ।
ইউনূস গোষ্ঠীর সাম্প্রতিক ক্ষমতা দখলের পর : আবারও একই চিত্র ফিরে এসেছে। পীর–আউলিয়া, গাউস–কুতুবদের অসংখ্য মাজার শরীফ ও দরগাহ পরিকল্পিতভাবে ভাঙা, জ্বালানো ও অপবিত্র করা হচ্ছে।
এই ইতিহাস প্রমাণ করে, ধর্মের আড়ালে রাজনীতি করার নামে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি বারবার বাংলাদেশের আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ওপর আঘাত হেনেছে।
ধর্মের নামে বিভ্রান্তি ছড়ানো
ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে যারা সাধু–বুজুর্গদের স্মৃতি ধ্বংস করছে, তাদের উদ্দেশ্য মোটেই ধর্মীয় নয়। এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ‘তৌহিদি জনতা’ নামটি ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের ধর্মীয় আবেগকে উত্তেজিত করা হচ্ছে। অথচ প্রকৃত সত্য হলো এটি মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ও জঙ্গিবাদী শক্তির পুনঃসংগঠনের কৌশল।
গোয়ালন্দের মাজার ভাঙচুর ও লাশ পোড়ানোর মতো ঘটনা শুধু স্থানীয় সমস্যা নয়, এটি একটি জাতীয় সংকেত। এই বর্বরতা প্রমাণ করে, সুযোগ পেলেই জামায়াত–বিএনপি দেশকে ধর্মীয় উগ্রতা ও সাম্প্রদায়িক বিভাজনের অন্ধকারে ঠেলে দিতে চায়।
বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ধরে রাখতে হলে এসব চরমপন্থী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিতে হবে। আমাদের আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য ও ধর্মীয় সহনশীলতা রক্ষার মধ্য দিয়েই জাতীয় ঐক্য সংহত করা সম্ভব।