।।ইব্রাহিম চৌধুরী।।
বাংলাদেশের রাজবাড়িতে যে ভয়ঙ্কর ও হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটেছে, তা কেবল একটি জেলার সীমায় সীমাবদ্ধ নয়; এটি সমগ্র জাতির সামনে এক নির্মম আয়না তুলে ধরেছে। কবর থেকে মরদেহ তুলে এনে উন্মত্ত জনতার হাতে পুড়িয়ে ফেলা—এই অমানবিকতা সভ্যতার জন্য লজ্জাজনক, ধর্মীয় মূল্যবোধের জন্য কলঙ্কজনক এবং রাষ্ট্রের জন্য চরম ব্যর্থতার প্রতীক। আমরা যে দেশে জন্ম নিয়েছি, যে সমাজে বেড়ে উঠেছি, সেই সমাজের মানুষই কীভাবে এতটা বর্বর হতে পারে—এই প্রশ্ন আজ সকলের মনে।
শুক্রবার জুমার নামাজের পর বেলা তিনটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত দফায় দফায় দরবারে হামলা করে একদল লোক। তাঁরা শরিয়ত–পরিপন্থীভাবে দাফনের অভিযোগ তুলে নুরাল পাগলার লাশ কবর থেকে তুলে পুড়িয়ে দেন। উপজেলা ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটির পূর্বঘোষিত বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে একদল লোকের এই হামলায় পুলিশ সদস্যসহ অন্তত অর্ধশত ব্যক্তি আহত হন। এ পর্যন্ত একজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। সেখানে পুলিশের দুটি গাড়ি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) গাড়ি ভাঙচুর করা হয়।
প্রথমত, ঘটনাটি আমাদের সামাজিক সংকটকে উন্মোচন করেছে। মৃত্যু মানুষের জীবনের চূড়ান্ত সমাপ্তি। জীবিত মানুষ নিয়ে যত মতভেদ, যত ক্ষোভ থাকুক না কেন, মৃত্যুর পর তাকে সম্মান দেওয়া আমাদের সংস্কৃতি, ধর্ম ও মানবিকতার মূল শিক্ষা। ইসলাম থেকে শুরু করে বিশ্বের সব ধর্মই মৃতদেহকে সম্মান করার কথা বলে। অথচ রাজবাড়ির ঘটনায় আমরা দেখলাম, মানুষ ধর্মীয় অনুশাসন ভুলে গিয়ে ঘৃণা, হিংসা আর উন্মত্ততার জ্বালায় এমন কাজ করল, যা ইতিহাসে অমানবিকতার প্রতীক হয়ে থাকবে।
দ্বিতীয়ত, এ ঘটনা প্রমাণ করেছে আমাদের সমাজে অসহিষ্ণুতা কতটা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। আমরা ভিন্নমত শুনতে চাই না, সহনশীলতার জায়গা ছেড়ে দিয়ে প্রতিহিংসাই হয়ে উঠছে চালিকা শক্তি। মৃত্যুর পরও কারো প্রতি রাগ-ক্ষোভ ধরে রাখা এবং তাকে কবর থেকে টেনে তুলে অপমান করা—এ যেন এক দৃষ্টান্ত, যেখানে সভ্যতার সব আলো নিভে গেছে। ধর্মীয় উন্মত্ত হয়ে আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে লোকজন। এ মানুষগুলো হঠাৎ করে কোথাও থেকে আসেনি। আমাদের সমাজেই এরা বেড়ে উঠেছে। এরা কোথাও চলে যাবে না। এমন লোকজনই আমাদের সমাজে বিরাজ করছে! আমাদের সামনেই একটা সমাজ বর্বরতার চূড়ান্তে পৌঁছেছে। এ দায় কার? আমরা কেউ কী এ দায় এড়াতে পারি?
রাষ্ট্রের দায় এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। যদি প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যথাসময়ে ব্যবস্থা নিত, যদি আইনের শাসন কার্যকর থাকত, তবে জনতার হাতে এ রকম নৃশংস কাজ সম্ভব হতো না। রাজবাড়ির এই ঘটনায় কোনোভাবেই উপেক্ষা করা যায় না।
গণমানসের সংকটও এখানে স্পষ্ট। যারা এই কাজ করেছে, তারা একা নয়; তাদের চারপাশে নিশ্চয়ই শত শত দর্শক ছিল। কেউ কি প্রতিবাদ করেছে? কেউ কি এমন উন্মত্ততা নিরসনে সামনে দাঁড়িয়েছে? আমরা কেউ বিশ্বাস করি না, সমাজের সব মানুষ এমন উন্মত্ততাকে সমর্থন করেছে। সমাজের নৈতিক শক্তি এতটাই ভেঙে পড়েছে যে, অমানবিকতার বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস মানুষ হারিয়ে ফেলেছে। এ এক ভয়ঙ্কর সংকেত। এটি প্রমাণ করে যে আমাদের শিক্ষা, ধর্মীয় দীক্ষা এবং সামাজিক চেতনা কোথাও বড় ধরনের ব্যর্থতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে।
এই ঘটনার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব ভয়াবহ। শিশু ও তরুণ প্রজন্ম যখন দেখে বড়রা কবর থেকে মরদেহ তুলে পুড়িয়ে ফেলছে, তখন তারা কেমন শিক্ষা পাবে? আগামী দিনের বাংলাদেশ কি তবে অমানবিকতা ও ঘৃণার ওপর দাঁড়িয়ে গড়ে উঠবে? যদি আমরা আজই এই সংকটের সমাধান না করি, তবে আগামী প্রজন্মের কাছে আমরা ক্ষমাহীন অপরাধী হয়ে থাকব।
রাজবাড়ির ঘটনাটির জন্য দায়ীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করতে হবে। এদের বিচার দ্রুততম সময়ে হওয়া উচিত। কেবল কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করলেই চলবে না; এই অমানবিকতায় জড়িত প্রত্যেককে আইনের আওতায় আনতে হবে। সমাজে অসহিষ্ণুতা ও উগ্রতার বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক ও শিক্ষামূলক কর্মসূচি চালু করতে হবে। মসজিদ, মন্দির, স্কুল, কলেজ—সব জায়গায় মানবিকতার শিক্ষাকে উর্ধ্বে তুলে ধরতে হবে। রাষ্ট্রকে ঘোষণা দিতে হবে যে, আইন কেউ নিজের হাতে তুলে নিলে পরিণতি ভয়াবহ হবে। ভিন্নমতের প্রতি ধর্মীয় হোক, সামাজিক হোক—সব ভিন্নমত ও পথের সামাজিক, নৈতিক প্রশ্ন থাকবে। কিন্তু এ নাগরিক প্রশ্নের সীমারেখা সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে। দেশটা মগের মুল্লুক হয়ে যায়নি। সবকিছু নষ্টদের অধিকারে চলে গেছে মনে করে বসে থাকারও কোনো অবকাশ নেই। সময় ও ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে স্পষ্ট বার্তা দিতে হবে যে, এই ধরনের কাজ কেউ করলে তাকে ছাড় দেওয়া হবে না।
সভ্যতার আসল পরীক্ষা কেবল প্রযুক্তি, অর্থনীতি বা রাজনীতিতে নয়; বরং মানবিকতা রক্ষার জায়গায়। সামাজিক অস্থিরতার নামে যা ঘটছে, এসব দেখে নিজেদের সভ্য বলার অধিকার আমাদের নেই। আজ প্রয়োজন এক কঠোর সামাজিক আত্মসমালোচনা, যেখানে আমরা সবাই নিজেদের কাছে প্রশ্ন করব—মানুষ হওয়ার মানে কী?
রাজবাড়ির কবর থেকে মরদেহ তুলে পুড়িয়ে ফেলার ঘটনা কেবলই কী একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা? না এটি আমাদের ভেতরের অন্ধকারের প্রতিফলন? সেই অন্ধকারকে দূর করার দায়িত্ব আমাদের সবার—রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তি মিলেই। নইলে ইতিহাসে আমরা কেবল কলঙ্কের পাতাতেই স্মরণীয় হয়ে থাকব।