ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ (বাগছাস) একটিও পদ না পাওয়ায় চরম বিপাকে পড়েছে এর পেছনে থাকা জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। কথিত ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান’-এর নেতৃত্ব দিয়ে আলোচনায় আসা বাগছাসকে ছাত্রসমাজ প্রত্যাখ্যান করেছে।
বিশ্লেষষকদের মতে, এনসিপির মুক্তিযুদ্ধ, গণবিরোধী ও দেশবিরোধী অবস্থান এবং সারাদেশে মব সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি-দখলবাজির রাজনীতির কারণেই ভোটাররা তাদের প্রত্যাখান করেছেন।
গত বছরের আগস্টে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবিতে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তার ফসল ছিল বাগছাসের উত্থান। কিন্তু বাস্তবে সংগঠনটি গঠনের পর থেকেই অন্তর্দ্বন্দ্ব, নেতৃত্ব সংকট ও বিভক্তি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যদিও বাগছাস আনুষ্ঠানিকভাবে এনসিপির অংশ নয় বলে দাবি করে, তবে রাজনৈতিক বাস্তবতায় সংগঠনটি এনসিপির ছায়াতলে পরিচালিত হচ্ছিল। ডাকসু ভোটের আগে এনসিপির শীর্ষ নেতারা বাগছাস প্রার্থীদের পক্ষে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্টেটাস দিয়ে ভোটও চেয়েছেন।
ডাকসু নির্বাচনে এনসিপি প্রত্যাশা করেছিল, বাগছাসের জয় তাদের জাতীয় রাজনীতিতে শক্তি ও মনোবল দেবে। কিন্তু বাস্তবতা হয়েছে উল্টো বাগছাসের ভরাডুবি এনসিপির রাজনৈতিক অস্তিত্বকেই প্রশ্নের মুখে ফেলেছে।
বাগছাস নেতারা ভেবেছিলেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থান’-এর অবদান ভোটে প্রতিফলিত হবে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং এনসিপির প্রতি ঘৃণার কারণে তারা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন। এনসিপির নেতারা অভিযোগ করছেন, বাগছাস তাদের সঙ্গে পরামর্শ না করে এককভাবে প্রার্থী নির্ধারণ করেছে। তবে ছাত্রসমাজের ভাষ্যে, এনসিপি নেতৃত্বাধীন রাজনীতি এখন জনবিচ্ছিন্ন, যারা গণতন্ত্র নয়, দখল আর ত্রাসের সংস্কৃতি চর্চা করে।
সহসভাপতি (ভিপি) পদে গুপ্ত সংগঠন শিবিরের প্রার্থী সাদিক কায়েম পেয়েছেন ১৪,০৪২ ভোট, যেখানে বাগছাসের আবদুল কাদের পেয়েছেন মাত্র ১,১০৩ ভোট পঞ্চম স্থান। সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদেও একই পরিণতি। শিবিরের এস এম ফরহাদ ১০,৭৯৪ ভোট পেলেও বাগছাস নেতা আবু বাকের মজুমদার মাত্র ২,১৩১ ভোট পেয়ে পঞ্চম হয়েছেন। এজিএস পদেও বাগছাসের মুখপাত্র আশরেফা খাতুন পেয়েছেন মাত্র ৯০০ ভোট, যা বাম ও স্বতন্ত্রদের চেয়েও কম।
এই হতাশাজনক ফলাফলের পেছনে বড় কারণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে সংগঠনটির ভেতরের বিদ্রোহ ও বিভক্তি। একাধিক পদে বাগছাস এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা একে অপরের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। যার ফলে ভোটারদের মধ্যে বিভ্রান্তি ও আস্থাহীনতা তৈরি হয়।
বাগছাসের জন্ম হয়েছিল একটি আদর্শিক ছাত্র আন্দোলনের উত্তরসূরি হিসেবে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি রাজনৈতিক দল এনসিপির ছত্রছায়ায় ঢুকে পড়ে, যারা মুক্তিযুদ্ধ ও প্রগতিশীল রাজনীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। একই সঙ্গে, এনসিপি নেতাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও শিক্ষাঙ্গনে দখলবাজির অভিযোগও আছে।
ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ মনে করে, এনসিপি হলো সেই পুরোনো রাজনৈতিক ধারার প্রতিফলনযারা ছাত্ররাজনীতিকে গণমুখী আন্দোলনের জায়গা থেকে সরিয়ে সন্ত্রাস ও নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার বানাতে চায়।
বাগছাসের পরাজয়ের আরেকটি বড় কারণ ছিল নেতৃত্বের বিভক্তি। একাধিক শীর্ষ নেতা বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, যার ফলে প্রচারণায় ছিল না ঐক্য বা সমন্বয়। মুখ্য সংগঠক তাহমীদ আল মুদ্দাসসীর নিজেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে জিএস পদে তৃতীয় হয়েছেন। উমামা ফাতেমা, আশিকুর রহমান জীম, রূপাইয়া শ্রেষ্ঠা, আবু সালেহীন অয়নসহ অনেক সামনের সারির নেতাই বাগছাসের বাইরে গিয়ে প্রার্থী হয়েছেন। রূপাইয়া শ্রেষ্ঠা উমামা ফাতেমার প্যানেলে প্রার্থী হয়ে চার হাজারের বেশি ভোট পেয়েছেন, যা বাগছাসের যেকোনো প্রার্থীর চেয়ে অনেক বেশি।
ডাকসু নির্বাচনের মাধ্যমে এনসিপি প্রমাণ করতে চেয়েছিল, তারা তরুণ সমাজে গ্রহণযোগ্য। কিন্তু ভোটারদের সরাসরি প্রত্যাখ্যান দেখিয়ে দিয়েছে তাদের সেই অবস্থান নেই। বরং, বাগছাসের ব্যর্থতা এনসিপিকে আরও দুর্বল ও প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। যারা রাজনীতিতে সহিংসতা, সন্ত্রাস ও কুক্ষিগত শক্তির চর্চা করেছে, ছাত্রসমাজ তাদের আর সমর্থন করতে চায় না।
এনসিপি ও বাগছাসের পতন কেবল নির্বাচনী পরাজয় নয় এটি একটি ছাত্রপ্রজন্মের গণতান্ত্রিক প্রত্যয়ের প্রকাশ, যারা সন্ত্রাস ও বিভ্রান্তিকর রাজনীতিকে স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে বলে মনে করেন সুধীজন।(বিডি ডাইজেস্ট প্রতিবেদন।)