সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠেন বরেণ্য সংগীতশিল্পী ফরিদা পারভীন। দাদি গান করতেন, বাবার ছিল গানের প্রতি অনুরাগ। লালনের গান গেয়ে ফরিদা পারভীন নিজেকে গগনস্পর্শী উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। এই লালনসম্রাজ্ঞী যদিও সংগীতজীবন শুরু করেছিলেন নজরুলগীতি, আধুনিক গান দিয়ে। দেশের গানেও ছিল তাঁর অনন্য কণ্ঠ। শৈশবের ওস্তাদ কমল চক্রবর্তীর কাছে তাঁর সংগীতে হাতেখড়ি। বাবার চাকরির সুবাদে দেশের বিভিন্ন জেলায় থাকা হয়েছে তাঁর।
১৯৬৮ সালে তিনি রাজশাহী বেতারে নজরুলশিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। কুষ্টিয়া শহরে তাদের পারিবারিক বন্ধু ছিলেন মোকছেদ আলী সাঁই। তিনি ফরিদা পারভীনকে ছোটবেলায় গান শেখাতেন। বাংলাদেশ বেতারের নিজস্ব শিল্পী ছিলেন তিনি।
১৯৭৪ সালে একদিন তাঁর ছাত্রীকে [ফরিদা পারভীন] গান গাওয়ার জন্য ঢাকায় বেতারের ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিসে নিয়ে এলেন। সঙ্গে তাঁর বাবাও ছিলেন। ফরিদা পারভীন তখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী।
মোকসেদ আলীকে রুমের বাইরে নিয়ে গিয়ে ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিসের সহকারী পরিচালক আশরাফুল আলম বলেন, মেয়েটা যে শিশু আগে বলেননি কেন? সে খুব বিব্রত বোধ করল। বলল ভাই, আপনারা তার গান একটু হলেও শোনেন। পরিচালক শহীদুল ইসলামের রুমে গান শোনার ব্যবস্থা করা হলো। ফরিদা পারভীনের প্রথম কণ্ঠ শুনে সেদিন নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল পুরো কক্ষ। পরে সবার অনুরোধে আরও তিনটি গান গেয়েও শোনান তিনি।
যখন হারমোনিয়ামটা তাঁর দিকে টেনে নিয়ে সামান্য সময় বাজিয়ে গান ধরলেন– ‘সত্য বল সুপথে চল..’ তখন উপস্থিত সবাই স্তম্ভিত ও আপ্লুত হয়ে গেলেন। কী যে কণ্ঠস্বর! কী যে গায়কি! কক্ষজুড়ে ছিল পিনপতন নীরবতা, সীমাহীন নিস্তব্ধতা। ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিস থেকে পাঁচটা গান রেকর্ড করা হলো ওই সার্ভিসের সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান ‘রংধনু’-তে প্রচারের জন্য।
অনুষ্ঠানটি ছিল ‘ন্যাশনাল হুক আপ’, যা বাংলাদেশ বেতারের সব কেন্দ্র থেকে একযোগে অভিজ্ঞ ও মানসম্পন্ন শিল্পীদের গান সম্প্রচার করা হতো। পরের সপ্তাহে ‘রংধনু’ অনুষ্ঠানে প্রচারের এই নীতিমালা ভেঙে ফরিদা পারভীনের পাঁচটি লালনগীতি বিশ মিনিট সময়জুড়ে বাংলাদেশ বেতারের সব কেন্দ্র থেকে প্রচার হয়েছিল। নিয়ম ভেঙে একজন শিশুশিল্পী বড়দের অনুষ্ঠানে গান গাইতে শুরু করে, যা এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ বেতারের ইতিহাসে প্রথম এবং শেষ ঘটনা।
মোকছেদ আলী সাঁইয়ের মৃত্যুর পর খোদাবক্স সাঁই, ব্রজেন দাস, বেহাল সাঁই, ইয়াছিন সাঁই ও করিম সাঁইয়ের কাছে লালনসংগীত শেখেন তিনি। ফরিদা পারভীনের গলার স্বর, পারফরম্যান্সের আন্তরিকতা এবং শব্দ-আলাপন বিশ্বসংগীতপ্রেমীদের মন জয় করে নিয়েছিল। ‘একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ অসংখ্য সম্মাননা অর্জন করেছেন তিনি। জাপান সরকার তাঁকে সম্মানিত করে কুফুওয়া এশিয়ান কালচারাল পদক দিয়ে।