।। আহমাদ ইশতিয়াক।।
ছবিটা দেখে স্রেফ স্তব্ধ হয়ে গেলাম। হায়রে সমাজের কুলাঙ্গার মানুষ! সামান্য এক বেলা খাবারের জন্য এরা কোন পর্যায়ে নামতে পারে।
.
ছবিটি একটি চল্লিশার অনুষ্ঠানের। ইসলামে যদিও এমন বিধান নেই, কিন্তু সমাজের প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী সাধারণত কেউ মারা যাওয়ার এক মাস বা চল্লিশ দিন পর চল্লিশার আয়োজন করে থাকে মৃতের পরিবার। আর ছবির এই চল্লিশা অনুষ্ঠান করা হয়েছে একটি পরিবারের অভাবের দায়ে আত্মহত্যা ও হত্যার শিকার চারজন সদস্যের জন্য।
.
গত ১৫ আগস্ট ঋণের দায়ে আর খাবারের অভাবে রাজশাহীর পবা উপজেলার মিনারুল ইসলাম নামের এক লোক আত্মহ’ত্যা করেছিলেন। আত্মহ’ত্যা করার আগে তিনি হ’ত্যা করেছিলেন স্ত্রী ও দুই সন্তানকেও। কারণ তিনি চেয়েছিলেন তার মতো অভাবে ধুঁকে ধুঁকে না মরে একবারেই মরে যাক তার পরিবার।
.
মিনারুল ও তাঁর স্ত্রী ছেলে মেয়ের মৃত্যুর এক মাস হওয়ায় সেই গ্রামের মানুষই মিনারুলের অসহায় বাবাকে বাধ্য করেছে চল্লিশার আয়োজন করতে। একপর্যায়ে মিনারুলের বাবা রুস্তম আলী বাড়িতে চল্লিশার আয়োজন করতে বাধ্য হন। মিনারুলের বাবা রুস্তম আলী বলেছিলেন, এই আয়োজন করতে তাঁকে ঋণ নিতে হয়েছে, যার জন্য তাঁকে সামনে জমি বিক্রিও করতে হবে।
.
আত্মহত্যার আগে মিনারুল একটি চিরকুটে লিখেছিলেন, ‘আমরা মরে গেলাম ঋণের দায়ে আর খাওয়ার অভাবে। এত কষ্ট আর মেনে নিতে পারছি না। তাই আমাদের বেঁচে থাকার চেয়ে মরে গেলাম, সেই ভালো হলো। কারও কাছে কিছু চাইতে হবে না।’
.
মিনারুলের বাড়ি রাজশাহীর পবা উপজেলার বামনশিকড় গ্রামে। গতকাল শনিবার দুপুরে সেখানে প্রথম আলোর রাজশাহী প্রতিনিধি গিয়ে দেখতে পান, ভ্যানে চড়ে দলে দলে মিনারুলের আত্মীয়স্বজনেরা বাড়িতে আসছে। দাওয়াত পেয়েছে গ্রামের মানুষেরাও। রুস্তম আলীর বাড়ির সামনে ও পেছনে দুটি প্যান্ডেল করা হয়েছে। ভাতের সঙ্গে ছিল ডাল ও মুড়িঘণ্ট। রুস্তম আলী ঘুরে ঘুরে আমন্ত্রিত অতিথিদের খাওয়ার তদারক করছিলেন।
.
রুস্তম আলী বললেন, ‘এই অনুষ্ঠানকে কেউ চল্লিশা বলে। কেউ বলে ফয়তা। সমাজের মানুষকে নিয়ে এটা করতে হয়। বাপ-দাদার আমল থেকেই এটা দেখে আসছি। যে যার সামর্থ্য অনুযায়ী করে। আমি গরিব মানুষ, মাংস করতে পারিনি। মাছ দিয়ে মুড়িঘণ্ট আর ডাল করেছি।’
.
রুস্তম আলী আরও বলেন, ‘আশপাশের মানুষজন বলছিল, চারজনের মরার কারণে বাড়ি ভারী ভারী লাগছে। ছোট ছিলেপিলেরা ভয় পাচ্ছিল। অনুষ্ঠানটা করলাম যাতে ভয় ভাঙে। বাড়ি যেন পাতলা হয়। দুপুরে দোয়া হয়েছে। তারপর খাওয়াদাওয়া। এজন্য প্রায় এক লাখ টাকা খরচ হলো। আত্মীয়স্বজন ও সমাজের লোক মিলিয়ে ১ হাজার ২০০ মানুষের আয়োজন করা হয়েছিল।’
.
টাকা জোগাড় হলো কীভাবে, জানতে চাইলে রুস্তম আলী বললেন, ‘সবই ধারদেনা। আমার তো জমানো টাকা নেই।’ শোধ করবেন কীভাবে, এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বললেন, ‘১৫-১৬ কাঠা জমি আছে। সেখান থেকে জমি বেচে ধার শোধ করব। তা ছাড়া তো আর কোনো উপায় নেই।’
.
হায়রে মানুষ। একটা লোক অভাব আর ঋণের দায়ে আত্মহত্যা করেছে। তাও একা না, আরও তিনজনকে মেরে; তার বিশ্বাস ওরাও অভাবের চেয়ে মরে যাওয়া ভালো। এমন একটা পরিবারের পাশে না দাঁড়িয়ে সেখানে তাঁর বাবাকেই বাধ্য করছে কুলখানি খাওয়ার জন্য।
.
সামান্য একবার খাবারের লোভে এরা কোন পর্যায়ে নামতে পারে? কি নির্মম এরা! একটা মানুষ ও তার গোটা পরিবার আত্মহত্যা করেও নিস্তার পায়নি। তার বাপের পরিবারকেও এবার এরা তিলে তিলে শেষ করছে। মানে আদৌ কি এরা মানুষের কাতারে পড়ে কিনা সন্দেহ হয়!
.
আমার মতে, এরকম আত্মীয় স্বজন থাকার চেয়ে নিঃসঙ্গ অবস্থায় মৃত্যুবরণও করাও অনেক ভালো!