চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলায় বাংলাদেশ পুলিশের একটি বিতর্কিত মাইকিং কার্যক্রম স্থানীয় জনমনে তীব্র প্রশ্ন ও উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। বুধবার বিকেলে কর্ণফুলী থানার পক্ষ থেকে মইজ্জ্যারটেক এলাকায় মাইকিংয়ের মাধ্যমে ঘোষণা দেওয়া হয়, ‘নিষিদ্ধঘোষিত দলের লোকজনকে বাসা ভাড়া দেওয়া যাবে না।’
স্থানীয় বাসিন্দারা ধারণা করছেন, এই নির্দেশে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। এই ঘটনা পুলিশের নিরপেক্ষতা এবং সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে।
ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ১ মিনিট ১৭ সেকেন্ডের একটি ভিডিওতে দেখা যায়, একজন ব্যক্তি সিএনজিচালিত অটোরিকশায় বসে কাগজ পড়ে মাইকিং করছেন।
তিনি বলেন, “সকল বাড়ির মালিককে জানানো যাচ্ছে, কর্ণফুলী থানা এলাকায় নতুন ভাড়াটিয়া নেওয়ার আগে তাদের ভোটার আইডি কার্ডসহ অন্যান্য ডকুমেন্ট থানায় জমা দিতে হবে। কোনো নিষিদ্ধঘোষিত দলের লোকজনকে বাসা ভাড়া দেওয়া যাবে না। যদি কোনো ভাড়াটিয়া নিষিদ্ধ দলের হয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে আটক হয়, তাহলে বাড়ির মালিককে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সহযোগী হিসেবে আটক করা হবে।”
ঘোষণাটি কর্ণফুলী থানার নির্দেশে সিএমপি’র পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।
কর্ণফুলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ শরীফ দাবি করেন, মাইকিংয়ে সরকারঘোষিত নিষিদ্ধ সব সংগঠনকে বোঝানো হয়েছে এবং কোনো নির্দিষ্ট সংগঠনকে ইঙ্গিত করা হয়নি।
যদিও স্থানীয়দের মধ্যে প্রবল ধারণা, এই নির্দেশের লক্ষ্য আওয়ামী লীগের সদস্যরা। এই ঘটনা প্রশ্ন তুলেছে—বাংলাদেশ পুলিশ কি ধরেই নিয়েছে যে আওয়ামী লীগ আর কখনো ক্ষমতায় ফিরবে না? আরও গুরুতর প্রশ্ন, বাংলাদেশ পুলিশের আইন ও বাংলাদেশের সংবিধান কি পুলিশকে এই ধরনের রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের অনুমতি দেয়? এটি কি সংবিধান পরিপন্থী নয়?
বাংলাদেশের সংবিধানের ২১(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রত্যেক নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের নিরপেক্ষভাবে এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। পুলিশের এই মাইকিং কার্যক্রম, যা স্থানীয়দের মতে একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলকে টার্গেট করছে, সংবিধানের এই মূলনীতির পরিপন্থী হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
বাংলাদেশ পুলিশ আইন, ১৮৬১ এবং পুলিশ রেগুলেশন বেঙ্গল (পিআরবি) অনুযায়ীও পুলিশের দায়িত্ব হলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা এবং নিরপেক্ষভাবে কাজ করা, রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব নয়।
এই ঘটনা পুলিশের উপর জনগণের দীর্ঘদিনের ক্ষোভকে আরও উসকে দিয়েছে। অতীতে পুলিশের ক্ষমতাসীনদের আজ্ঞাবহ ভূমিকা জনমনে ব্যাপক অসন্তোষের জন্ম দিয়েছে।
বিশেষ করে, গত বছরের সরকারবিরোধী আন্দোলনের সময় পুলিশের বিরুদ্ধে দমন-পীড়নের অভিযোগ উঠেছিল। এই সময়ে জনতার হাতে শতাধিক পুলিশ সদস্য নৃশংসভাবে হত্যা এবং অসংখ্য পুলিশ আহত হয়, যা পুলিশের প্রতি জনগণের ক্ষোভের তীব্রতা প্রকাশ করে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, পুলিশের এই ধরনের রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব মূলক পদক্ষেপ জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি ও অসন্তোষ বাড়াতে পারে। আইনের নিরপেক্ষ প্রয়োগের পরিবর্তে রাজনৈতিক দলকে টার্গেট করার ধারণা জনমনে সংবিধান ও আইনের শাসন নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।
স্থানীয়রা মনে করছেন, এই মাইকিংয়ের মাধ্যমে পুলিশ ইঙ্গিত দিচ্ছে যে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে তারা নিশ্চিত যে এই দল আর ক্ষমতায় ফিরবে না। তবে এই ধরনের পদক্ষেপ পুলিশের নিরপেক্ষতা ও পেশাদারিত্ব নিয়ে নতুন করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে এই ঘটনা বৃহত্তর প্রশ্ন তুলেছে। পুলিশের এই কার্যক্রম যদি সংবিধান ও আইনের পরিপন্থী হয়, তবে এটি জনগণের মৌলিক অধিকার এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের উপর আঘাত হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে পুলিশকে স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ এবং সাংবিধানিকভাবে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন স্থানীয়রা।