ভারত আগামী ২৪-২৫শে সেপ্টেম্বর বঙ্গোপসাগরে একটি গুরুত্বপূর্ণ মিসাইল পরীক্ষা চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে, যা এই অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। এমন এক সময় ভারত এই ঘোষণা দিলো, যখন চট্টগ্রামে মার্কিন সেনাদের চলমান সামরিক প্রশিক্ষণ এবং যৌথ মহড়া চলছে; আর এসব বিষয় ভারতকে তার প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সীমান্ত নিরাপত্তা নিয়ে ক্রমশ ভাবিয়ে তুলেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ঘটনাপ্রবাহ বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার পরবর্তী ‘হটস্পট’ করে তুলতে পারে, বিশেষ করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তের কাছাকাছি চট্টগ্রামের কৌশলগত অবস্থানের কারণে।
ভারতের প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা (ডিআরডিও) এই পরীক্ষার জন্য নোটিস টু এয়ারম্যান (নোটাম) জারি করেছে, যা ওড়িশার আব্দুল কালাম দ্বীপ থেকে মিসাইল উৎক্ষেপণের ইঙ্গিত দেয়।
নোটাম অনুসারে, ২৪শে সেপ্টেম্বর দুপুর ১২:৩০ থেকে ২৫ সেপ্টেম্বর বিকেল ৩:৩০ পর্যন্ত বঙ্গোপসাগর এবং ভারত মহাসাগরের বিশাল অংশ নো-ফ্লাই জোন ঘোষিত হবে। পরীক্ষার পরিধি প্রায় ১ হাজার ৪৩০ কিলোমিটার, যা ডিআরডিওর হাইপারসনিক লং-রেঞ্জ অ্যান্টি-শিপ মিসাইল (এলআরএএসএইচএম)-এর সাথে মিলে যায়। এই মিসাইলের গতি ম্যাক ১০-এর কাছাকাছি এবং পরিধি ১ হাজার ৫০০ কিলোমিটার, যা শত্রুপক্ষের নৌবাহিনীর জাহাজগুলোকে আঘাত করার উদ্দেশে নির্মিত।
এটি এই মিসাইলের দ্বিতীয় পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণ হতে পারে, যা ভারতের কৌশলগত প্রতিরক্ষা ক্ষমতা শক্তিশালী করার অংশ।
এই পরীক্ষার সময়সীমা যখন চলছে, তখন চট্টগ্রামে মার্কিন সেনাদের উপস্থিতি দেশে এবং আঞ্চলিক উদ্বেগ বাড়িয়েছে। গত সপ্তাহে মার্কিন বিমানবাহিনীর সি-১৩০জে সুপার হারকিউলিস পরিবহন বিমান চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেছে, যা ‘প্যাসিফিক অ্যাঞ্জেল ২৫-৩’ যৌথ অনুশীলনের অংশ বলে দাবি করা হয়েছে। চার দিনের এই অনুশীলন যুক্তরাষ্ট্র, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার বিমানবাহিনী অংশগ্রহণ করছে, যা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, মানবিক সহায়তা এবং যৌথ অপারেশনের লক্ষ্যে পরিচালনা করা হচ্ছে।
এছাড়া, গত ১০ই সেপ্টেম্বর প্রায় ১২০ মার্কিন সেনা সদস্য চট্টগ্রামের র্যাডিসন ব্লু হোটেলে উঠেছেন, যা যৌথ প্রশিক্ষণের জন্য। এর আগে এ বছর ‘টাইগার লাইটনিং ২০২৫’ এবং ‘টাইগার শার্ক ২০২৫’ অনুশীলন চট্টগ্রাম এবং সিলেটে অনুষ্ঠিত হয়েছে, যাতে কাউন্টার-টেররিজম, জঙ্গল যুদ্ধ এবং মেডিকেল ইভ্যাকুয়েশনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
চট্টগ্রামের কৌশলগত গুরুত্ব অস্বীকার্য—এটি বাংলাদেশের একমাত্র গভীর সমুদ্রবন্দর এবং ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল (সেভেন সিস্টার্স) এবং মিয়ানমারের সীমান্তের কাছে অবস্থিত।
মার্কিন উপস্থিতি শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে বেড়েছে, যা ইউনূস সরকারের সময় আরও স্পষ্ট। ভারত ও মিয়ানমারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো একে চীনবিরোধী কৌশলের অংশ হিসেবে দেখলেও এতে স্থানীয় নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়ার আশঙ্কা করছে। গত মে মাসে বাংলাদেশ থেকে সম্ভাব্য সন্ত্রাসী হুমকির গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ভারত তার স্থল, আকাশ ও জলপথের নিরাপত্তা জাল শক্তিশালী করেছে। জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি)-এর মতো নিষিদ্ধ গোষ্ঠীর কার্যকলাপ বাড়ছে বলে ভারতীয় গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে।
ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সীমান্ত নিরাপত্তা নিয়ে দীর্ঘদিনের উদ্বেগ এখন বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে আরও তীব্র হয়েছে। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত ৪ হাজার ৯৬ কিলোমিটার দীর্ঘ। অসংখ্য নদী-নালার কারণে অরক্ষিত, যা অবৈধ অভিবাসন, গবাদি পশু চোরাচালান, মাদক পাচার এবং সন্ত্রাসবাদী অনুপ্রবেশের জন্য হটস্পট।
গত জানুয়ারিতে ভারতের সীমান্তে বেড়া নির্মাণ নিয়ে বাংলাদেশের বিরোধিতা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে চাপের মুখে ফেলেছে। উত্তরবঙ্গের কোচবিহার এলাকা এমন একটি স্থান, যেখানে অভিবাসনের চাপ সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মার্কিন উপস্থিতি এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব কমানোর জন্য হলেও, এটি ভারতের নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ বাড়াতে পারে।
“বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং বহিরাগত হস্তক্ষেপ এটিকে পরবর্তী হট স্পটে পরিণত করতে পারে, বিশেষ করে সিলিগুড়ি করিডরের মতো সংবেদনশীল এলাকার কাছে,” বলছেন একজন ভারতীয় কৌশলগত বিশ্লেষক।
ভারতের এই মিসাইল পরীক্ষা তার প্রতিরক্ষা ক্ষমতা প্রদর্শনের একটি অংশ, যা চীন এবং পাকিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ। তবে, বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনতি এবং মার্কিন কার্যকলাপ এই অঞ্চলকে আরও অস্থির করে তুলতে পারে। দুই দেশের সীমান্ত রক্ষীবাহিনী (বিএসএফ এবং বিজিবি) এবং কূটনৈতিক স্তরে সংলাপ বাড়ানোর দাবি উঠছে, যাতে এই উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণে থাকে।