যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলন প্রক্রিয়াকে ‘সম্পূর্ণ স্বচ্ছ’ করা হবে মর্মে ঘোষণা দেয়া, বঙ্গোপসাগরের তেল ও গ্যাস সমৃদ্ধ ব্লকগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে জনমনে উদ্বেগ বাড়ছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কি এই ব্লকগুলো একক মার্কিন কোম্পানির হাতে তুলে দিতে চলেছে? এর পেছনে কি পূর্বের ‘নন-ডিসক্লোজার চুক্তি’র ছায়া রয়েছে?
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ২০২৫ সালের ফিসকাল ট্রান্সপারেন্সি রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশ প্রাকৃতিক সম্পদের ক্রয় প্রক্রিয়ায় ‘উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি’ দেখিয়েছে।
১৯শে সেপ্টেম্বর প্রকাশিত এই রিপোর্টে জানানো হয়, পূর্ববর্তী সরকারের গোপন আলোচনার প্রথা বন্ধ করে সকল চুক্তি উন্মুক্ত টেন্ডারের মাধ্যমে হবে। তবে এই ‘স্বচ্ছতা’র ঘোষণা সত্ত্বেও, বিশ্লেষকরা সন্দেহ করছেন, বঙ্গোপসাগরের ২৬টি ব্লক (১১টি অগভীর এবং ১৫টি গভীর সমুদ্র) মার্কিন কোম্পানি যেমন এক্সঅনমবিল বা শেভরনের হাতে চলে যেতে পারে।
শেখ হাসিনা সরকারের আমলে পরিকল্পনা ছিল এই ব্লকগুলো ২-৩টি দেশের কোম্পানির মধ্যে ভাগ করে দেওয়া, যাতে বাংলাদেশ কোনো একক বিদেশি প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে না পড়ে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভারত ও মায়ানমারের নিকটবর্তী এলাকায় তেল ও গ্যাসের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। ২০২৪ সালে পেট্রোবাংলার টেন্ডারে ৭টি বিদেশি কোম্পানি আগ্রহ দেখালেও কোনো বিড জমা পড়েনি। এখন মার্কিন-সমর্থিত ‘স্বচ্ছতা’র ঘোষণা এই আশঙ্কাকে উসকে দিচ্ছে যে, সকল ব্লক এক মার্কিন কোম্পানির হাতে যেতে পারে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মার্কিন কোম্পানিগুলো প্রাকৃতিক সম্পদের উপর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য কুখ্যাত। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটি সেই ‘নন-ডিসক্লোজার চুক্তি’র মাধ্যমে হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। পেট্রোবাংলার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, “টেন্ডার ব্যর্থ হওয়ায় সরাসরি আলোচনার সুযোগ তৈরি হয়েছে। মার্কিন চাপে সব ব্লক এক হাতে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ববিদ প্রফেসর বদ্রুল ইমাম বলেন, “বঙ্গোপসাগরের ৯০% এলাকা এখনও অনাবিষ্কৃত। স্বচ্ছতার নামে একক নিয়ন্ত্রণ দেশের স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর হবে।” রাজনৈতিক মহল এটিকে ‘মার্কিন হস্তক্ষেপ’ হিসেবে দেখছে। সরকারের এক মুখপাত্র দাবি করেন, “আমরা স্বচ্ছতায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, কোনো গোপন চুক্তি নেই।” তবে জনমনে প্রশ্ন, এই স্বচ্ছতা কি জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করবে, নাকি বঙ্গোপসাগরের সম্পদ বিদেশি হাতে তুলে দেবে?
বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাসে বলা হয়, ২০২৫ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতি ৪% বৃদ্ধি পাবে, তবে প্রাকৃতিক সম্পদের সঠিক ব্যবস্থাপনা ছাড়া এটি কঠিন। সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপই নির্ধারণ করবে, বঙ্গোপসাগরের সম্পদ দেশের উন্নয়নে কাজে লাগবে, নাকি বিদেশি নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে।