।।কামরুল হাসান মামুন।।
বাংলাদেশে বিশ্বমানের বিজ্ঞানী, বিশ্বমানের প্রকৌশলী, বিশ্বমানের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের এক মারাত্মক সংকট চলছে। অসংখ্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব যেমন কবি, সাহিত্যিক ও শিল্পী দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ায় দেশে মারাত্মক একটা সাংস্কৃতিক সংকট চলছে। আমি ভাবতেই পারি না যেই দেশ আউল বাউল, ভাটিয়ালি, পল্লীগীতি, পালাগান, জারি–সারি, মারফতি ও ঘেটু গানের দেশ সেই দেশে সঙ্গীত শিক্ষক নিয়োগের সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবি কেমন করে হয়? যারা এমন দাবি করছে তারা এই দেশকে কি বানাতে চায়?
সংগীত মানুষের সভ্যতার অন্যতম প্রাচীন ও গভীরতম অভিব্যক্তি। শব্দ ও ছন্দের সৃজনশীল বিন্যাসে যে সুর জন্ম নেয়, তা শুধু বিনোদন নয়—বরং মানুষের আবেগ, চিন্তা, স্মৃতি আর সংস্কৃতিরও বাহক। মানবসভ্যতার প্রতিটি যুগে সংগীত মানুষকে একদিকে যেমন ঐক্যবদ্ধ করেছে। সংগীতের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো এর আবেগময় প্রভাব। মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, সুর ও তাল মানুষের মস্তিষ্কে একধরনের নিউরোকেমিক্যাল প্রতিক্রিয়া তৈরি করে যা আনন্দ, প্রশান্তি ও সহমর্মিতা বাড়ায়। শোকের মুহূর্তে সংগীত যেমন সান্ত্বনা দেয়, তেমনি উৎসবের মুহূর্তে আনন্দকে বহুগুণ বাড়িয়ে তোলে।
সংগীত শুধু আবেগ নয়, শৃঙ্খলাও শেখায়। তাল, লয়, সুর—সব মিলিয়ে যে কাঠামো তৈরি হয় তা শিক্ষার্থীদের মনোযোগ, ধৈর্য এবং আত্মনিয়ন্ত্রণ বাড়াতে সহায়তা করে। বিশ্বের অনেক দেশেই শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষায় সংগীত অন্তর্ভুক্ত করা হয় এই কারণেই। একটি সমাজের ঐতিহ্য, বিশ্বাস, আচার ও মূল্যবোধ সংগীতের মাধ্যমেই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বহমান থাকে। লোকসংগীত, গীতিকবিতা, ভজন, বাউলগান, জারি–সারি কিংবা রবীন্দ্রসংগীত—সবই আমাদের ইতিহাস ও সংস্কৃতির জীবন্ত দলিল।
প্রাচীন গ্রীসের পিথাগোরাস থেকে শুরু করে আধুনিক যুগের বিজ্ঞানীরা পর্যন্ত সবাই সংগীত ও গণিতের গভীর সম্পর্কের কথা বলেছেন। সুরের প্যাটার্ন, হারমনিক অনুপাত, ফ্রিকোয়েন্সি—সবই প্রকৃতপক্ষে গাণিতিক। তাই সংগীতের চর্চা বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়নেও ভূমিকা রাখে। সংগীত ভাষা, জাতি ও ধর্মের সীমারেখা ভেদ করে এক বিশ্বজনীন অভিজ্ঞতা সৃষ্টি করে। একটি গানের সুরে যেমন ঢাকাইয়া, কলিকাতার বা নিউ ইয়র্কের শ্রোতাও সমানভাবে আবেগান্বিত হতে পারে। এই দিক থেকেই সংগীতকে বলা হয় ‘বিশ্বের একমাত্র সত্যিকারের সার্বজনীন ভাষা’।
সংগীত মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় থেরাপির মত কাজ করে। বর্তমানে সংগীত থেরাপি মানসিক চাপ কমাতে, উদ্বেগ হ্রাস করতে ও রোগীর ইতিবাচক মনোভাব ফিরিয়ে আনতে ব্যবহৃত হচ্ছে। মস্তিষ্কের বিভিন্ন অঞ্চলে সংগীতের উদ্দীপনা স্মৃতিশক্তি ও মনোযোগ বাড়াতে সাহায্য করে। সংগীত মানুষের জীবন থেকে শুধু বিনোদনের উপাদান নয়, বরং এটি একধরনের মানসিক আশ্রয়, সামাজিক বন্ধন এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়ের বাহক। আধুনিক যান্ত্রিক জীবনে যখন মানুষ বিচ্ছিন্নতা ও মানসিক চাপে ভুগছে, তখন সংগীতই হতে পারে মনের ও আত্মার পুনর্জাগরণের শক্তি।