সুফাল সরকার
বাংলা ভাষা কেন ভারত বা বিশ্বের অন্যতম সুমিষ্ট ভাষা, তা বোঝার জন্য আমাদের ভাষার গঠন, উচ্চারণ, ধ্বনি, সাহিত্য ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির প্রভাব একত্রে বিচার করতে হয়। প্রথমেই বলতে হয়, একটি ভাষার সুমিষ্টতা নির্ভর করে তার শব্দের সুরেলা ধ্বনি, সহজ উচ্চারণ, মাধুর্যমণ্ডিত ছন্দ, গানের মতো বুনন এবং মানুষের আবেগ প্রকাশের ক্ষমতার ওপর। বাংলা ভাষা এই সব ক’টি দিক থেকেই অনন্য।
বাংলা ভাষার ধ্বনিগত বৈশিষ্ট্য অন্য অনেক ভাষার তুলনায় অধিক কোমল। এখানে শব্দগঠন সাধারণত ব্যঞ্জনবহুল নয়, স্বরবর্ণের ব্যবহার বেশি, যার ফলে উচ্চারণে সুরেলা ধ্বনি তৈরি হয়। কোনো কঠিন গলার আওয়াজ বা অতিরিক্ত চাপ নেই, বরং এক ধরনের কোমলতা ও স্নিগ্ধতা রয়েছে। ফলে বাংলা ভাষার শব্দ কানে লাগে মধুর, বিশেষ করে যারা বাংলা মাতৃভাষা নয়, তাদের কাছেও বাংলার সুরেলা ধ্বনি আকর্ষণীয় মনে হয়। এই ধ্বনিগত বৈশিষ্ট্যই বাংলাকে সঙ্গীতের ভাষা করে তুলেছে।
বাংলা সাহিত্যে কবিতা, গান ও গদ্যের যে ঐশ্বর্য, তা ভাষার সুমিষ্টতাকে আরও উজ্জ্বল করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কবিতা ও গানে বাংলার মাধুর্যকে বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর রচিত “গীতাঞ্জলি” কেবল বাংলা ভাষার গীতিময়তা নয়, বরং মানুষের আবেগ প্রকাশে এ ভাষার অপূর্ব ক্ষমতা প্রমাণ করে। কাজী নজরুল ইসলামের গান ও কবিতা, জীবনানন্দ দাশের কাব্যভাষা, লালনের বাউলগান—সবই বাংলা ভাষার মাধুর্যের সাক্ষ্য বহন করে। একটি ভাষার মাধুর্য তার সংগীতে সবচেয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, আর বাংলা গান, বিশেষত রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি, বাউল, ভাটিয়ালি কিংবা লোকগীতি সেই মাধুর্যকে বিশ্বমানের স্বীকৃতি দিয়েছে।
বাংলা ভাষার দৈনন্দিন ব্যবহারেও রয়েছে এক ধরনের অন্তরঙ্গতা ও স্নেহ। মা সন্তানের সঙ্গে যেমন সহজ, স্নিগ্ধ শব্দ ব্যবহার করে কথা বলে, বাংলায়ও সেই ধরনের কোমল ধ্বনি বেশি দেখা যায়। “মা”, “বাবা”, “ভালোবাসা”, “আলো”, “নদী”, “আকাশ”—এসব শব্দের ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক ধরনের স্নিগ্ধ ছন্দ, যা হৃদয়কে স্পর্শ করে। অন্যদিকে অনেক ভাষায় যেখানে শক্ত, কর্কশ ধ্বনির আধিক্য, সেখানে বাংলা সবসময় স্নিগ্ধ, সহজ আর আবেগঘন।
এছাড়া বাংলার ইতিহাসেও ভাষার মাধুর্য প্রমাণিত হয়েছে। বাংলা ভাষা আন্দোলন এ ভাষাকে মর্যাদার শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছে। ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন মানবসভ্যতার ইতিহাসে বিরল ঘটনা। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন বিশ্ববাসীকে প্রমাণ করে দিয়েছে যে বাংলা কেবল যোগাযোগের মাধ্যম নয়, এটি মানুষের অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে থাকা আত্মার ভাষা। এই আত্মার টানও ভাষার সুমিষ্টতাকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে।
বিশ্বসাহিত্যে বাংলা ভাষার বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। ইউনেস্কো বাংলা ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে। এর মধ্য দিয়েই প্রমাণিত হয়েছে বাংলা ভাষার বিশ্বজনীন আবেদন। সুমিষ্টতা শুধু ধ্বনির মধ্যে নয়, বরং আবেগ, সংস্কৃতি ও মানবিকতার প্রকাশে।
বাংলার লোকসংস্কৃতিও এই ভাষাকে বিশেষ রূপ দিয়েছে। ভাটিয়ালি গানে নদীর স্রোতের মতো টান, বাউল গানে হৃদয়ের ব্যাকুলতা, কীর্তনে ভক্তির আবেগ—এসব মিলিয়ে বাংলা ভাষা হয়ে উঠেছে এক অনুপম শিল্পমাধ্যম। ভাষার প্রতিটি বাঁক, প্রতিটি শব্দ যেন কোনো না কোনো সংগীতের অংশ।
এই সব কারণেই বাংলা ভাষাকে ভারতের তথা বিশ্বের অন্যতম সুমিষ্ট ভাষা বলা হয়। এর শব্দে সুর আছে, উচ্চারণে কোমলতা আছে, সাহিত্যে গভীরতা আছে, সংগীতে অনন্যতা আছে এবং মানুষের হৃদয়ে আবেগ আছে। অনেক ভাষাবিদ ও সাহিত্য সমালোচক একবাক্যে স্বীকার করেছেন—বাংলা ভাষা শুনলেই মনে হয় এটি যেন এক অবিরাম গানের ধারা। তাই ভাষার সুমিষ্টতার বিচারে বাংলা শুধু ভারতের নয়, বিশ্বের গর্বের ভাষা।