ভাষাসৈনিক, কবি, প্রাবন্ধিক ও রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ আহমদ রফিক (৯৬) ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না এলাহি রাজিউন)। রাজধানীর বারডেম হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহস্পতিবার রাত ১০টা ১২ মিনিটে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
আহমদ রফিকের বিশেষ সহকারী মো. রাসেল ও গাড়ি চালক মো. কালাম সাংবাদিকদের তাঁর মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করেছেন। বারডেম হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানান, মৃত ঘোষণা করার সাত মিনিট আগে তাঁর কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়।
এর আগে শারীরিক অবস্থা অবনতি হওয়ায় বুধবার বিকেলে তাঁকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, বারডেম হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগের প্রধান ডা. কানিজ ফাতেমার তত্ত্বাবধানে তাঁর চিকিৎসা চলছিল। কিডনির সমস্যার পাশাপাশি সম্প্রতি কয়েকবার ‘মাইল্ড স্ট্রোক’-এর শিকার হন তিনি।
এর আগে গত ১১ সেপ্টেম্বর ল্যাবএইড হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পাওয়ার পর তাঁকে পান্থপথের হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল।
তবে সেখানে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সুবিধা না থাকায় গত রবিবার তাঁকে বারডেম হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।
আহমদ রফিক নিউ ইস্কাটনের গাউসনগরের একটি ভাড়া বাসায় একাই বসবাস করতেন। ১৯২৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জন্ম গ্রহণ করেন এই ভাষাসৈনিক। তিনি ২০০৬ সালে স্ত্রীকে হারান। তিনি নিঃসন্তান ছিলেন।
শতাধিক গ্রন্থ রচনা ও সম্পাদনা করেছেন আহমদ রফিক। পেয়েছেন একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ বহু সম্মাননা। দুই বাংলার রবীন্দ্রচর্চায় তার অবদান অনন্য; কলকাতার টেগর রিসার্চ ইনস্টিটিউট থেকে তাকে দেওয়া হয়েছে ‘রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য’ উপাধি।
জানা গেছে, মৃত্যুর আগে তিনি তাঁর মরদেহ ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল মেডিক্যাল কলেজে দান করে গেছেন।
মহিয়সী ইলা মিত্র পাকিস্তানি পুলিশের অবর্ণনীয় অত্যাচারে সয়ে মুমুর্ষূ অবস্থায় চিকিৎসাধীন ছিলেন ঢাকা মেডিক্যালে। আহমদ রফিক তখন ছাত্র। পুলিশ বেষ্টনী ভেদ করে ইলা মিত্রের কাছে বাইরের খবর পৌঁছে দিতেন তিনি। আবার ইলা মিত্রের খবর জানাতেন বাইরে। তার হোস্টেলের রুম ছিল প্রগতিশীল রাজনীতিবিদদের আশ্রয়।
তারপরে তো ভাষা আন্দোলন। সেই রুমটাই প্রথম শহীদ মিনার তৈরির সিদ্ধান্ত নেবার জায়গা। একরাতের মধ্যেই শহীদ মিনার তৈরি করা।
খুব ভালো রেজাল্ট করে ডাক্তারি পাশ করেছিলেন তিনি। কিন্তু ডাক্তারির চাইতে সাহিত্য আর বাম রাজনীতি তাঁর কাছে অগ্রাধিকার পেয়েছে সবসময়।
বের করেছিলেন আধুনিক সাহিত্য পত্রিকা ‘নাগরিক’।
এই তো ২০১৭ সালেও রুশ বিপ্লবের শতবার্ষিকী উদযাপনের অনুষ্ঠান নামক কর্মযজ্ঞে তিনি এবং সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ছিলেন যৌথ আহ্বায়ক। সেদিন প্রকাশিত হলো আমার উপন্যাস ‘১৯৯২’। আরো অনেকের মতো তিনিও আপ্লুত হয়েছিলেন। এই রকম অনুষ্ঠানে স্মরণিকা হয়, পত্রিকা হয়, কিন্তু কোনো লেখক তার বই প্রকাশ করছে, বাংলাদেশে এমন ঘটনা সচরাচর ঘটে না।
পরবর্তী জীবনটা রোগে, শোকে, বার্ধক্যে বড় কষ্টে কেটেছে তাঁর। তবে প্রগতিশীল সাহিত্যমনা মানুষ অনেকেই তাঁর পাশে ছিলেন আমৃত্যু। আমি অতোটা থাকতে পারিনি। ঢাকার বাইরে অবস্থানের কারণে। এখন এজন্য নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে।
ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক-এর মৃত্যুতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের শোক
ভাষাসংগ্রামী, কবি, প্রাবন্ধিক ও রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ আহমদ রফিক-এর মৃত্যুতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করছে। একইসাথে মরহুমের আত্মার মাগফিরাত ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছে।
উল্লেখ্য, ভাষা সংগ্রামী আহমেদ রফিক ভাষা আন্দোলনের অন্যতম প্রাবন্ধিক ইতিহাসবিদ শতাধিক গ্রন্থ রচনা ও সম্পাদনা করেছেন। পেয়েছেন একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ বহু সম্মাননা। দুই বাংলার রবীন্দ্রচর্চায় তাঁর অবদান অনন্য; কলকাতার টেগর রিসার্চ ইনস্টিটিউট থেকে তাঁকে দেওয়া হয় ‘রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য’ উপাধি। তিনি রাজধানীর বারডেম হাসপাতালের বৃহস্পতিবার রাতে ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না এলাহি রাজিউন)। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৬ বছর এবং তিনি পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, সহকর্মী, গুণগ্রাহী ও শুভানুধ্যায়ী রেখে গেছেন।
লেখক. চলচ্চিত্রকার ও স্থপতি শাকুর মজিদ বলেন,
তাঁর যখন ৭৫, তিনি মনে করেছিলেন আর হয়ত ৫ বছর বাঁচবেন। তিনি নি:সন্তান, পরিজনহীন, একাকী।
তিনি ঠিক করলেন, আগামী ৫ বছর বেঁচে থাকতে যে পরিমান অর্থ খরচ হতে পারে তা নিজের জন্য রেখে বাকিটা বিলিয়ে দিবেন।
দিলেনও।
কিন্তু এই ৫ বছরে তিনি মারা গেলেন না। বেচে থাকলেন। কিন্তু তাঁর হাতে টাকা কড়ি থাকলো না।
অর্থ কষ্টে ভুগতে শুরু করলেন। সম্বল লেখা লেখি। প্রকাশকদের তাগাদা দিতে থাকেন টাকার জন্য, পত্রিকায় লেখার বিলের জন্য প্রত্যাশা বাড়তে লাগলো। এবং এমন করে করে বেশ কয়েক বছর তিনি বেঁচে থাকলেন
১৯৫২ সালে তিনি ঢাকা মেডিক্যালের ছাত্র। ভাষা আন্দোলনের সময় জেল খাটতে গিয়ে মেডিক্যালের পরীক্ষা দেয়া হয় নি। পরে পাশ করে বেরিয়েছিলেন।
ডাক্তারী করেওছিলেন কয়েক বছর। একটা ঔষধ শিল্পের সাথেও ছিলেন। সেসব ছেড়ে ভাষা আন্দোলন আর গবেষনা (বিশেষ করে রবীন্দ্র গবেষনায়) জীবনটাই কাটিয়ে দিলেন। থাকতেন আমাদের উল্টাদিকের বিল্ডিং এ।
ইস্কাটন রোড় ( যার নাম ছিল রাশেদ খান মেনন রোড) থেকে আমাদের পাড়ার দিকে যে সরু পথ, এখানে একবার তাঁর নামে সড়কের নাম ফলক ছিল। আহমদ রফিক সড়ক। এই ফলকটি এখন আর নাই। আজ তিনি চলেই গেলেন, অন্তত তাঁর নামের এই ফলকটি স্থায়ী ভাবে লাগানো হোক।