বাংলাদেশের ইতিহাসে ২০২৪ সালের জুলাই মাস একটি কালো অধ্যায় হয়ে থাকবে। “জুলাই যোদ্ধা” নামে পরিচিত গোষ্ঠী কেবল একটি গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করেনি; বরং পুরো জাতির গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে। এই দখলদারিত্বের পর রাষ্ট্রযন্ত্র জনগণের সেবক থেকে দমননীতির প্রভুতে রূপ নিয়েছে।
আজকের বাংলাদেশে সত্য বলা অপরাধে পরিণত হয়েছে। সংবাদপত্র, টেলিভিশন, অনলাইন প্ল্যাটফর্ম সবখানেই চলছে একের পর এক দমন অভিযান। আন্তর্জাতিক সংগঠন *রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (RSF)* ২০২5 সালের সূচকে বাংলাদেশকে গণমাধ্যম স্বাধীনতায় বিশ্বের নিচের সারিতে রেখেছে। আর্টিকেল ১৯ এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জুলাই ডিসেম্বর ২০২৪ মাত্র ছয় মাসে **৩৪০ জন সাংবাদিক হামলা, হয়রানি বা গ্রেপ্তারের শিকার হয়েছেন**। এটি কেবল সেন্সরশিপ নয়; বরং ভিন্নমত নিশ্চিহ্ন করার সুপরিকল্পিত কৌশল।
*গণমাধ্যমের ওপর দমননীতি*
অবৈধ শাসনের প্রথম শিকার হয়েছে গণমাধ্যম। **প্রথম আলোর অনলাইন এডিশন কয়েকদিন ব্লকড**, *সমকাল*–এর ছাপাখানা বন্ধ করে দেওয়া, *চ্যানেল ২৪* ও *সময় টিভি*–এর লাইসেন্স ঝুঁকিতে ফেলা এসব কেবল উদাহরণ মাত্র। সাংবাদিকদের প্রেস অ্যাক্রেডিটেশন বাতিল করে সংসদ ও সচিবালয়ে প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়েছে।
তথ্য অধিকার আইনও অকার্যকর হয়ে পড়েছে। সাংবাদিকরা সরকারি নথি চাইলে ‘জাতীয় নিরাপত্তা’ অজুহাতে প্রত্যাখ্যাত হচ্ছেন। অথচ জনগণের জানার অধিকার গণতন্ত্রের মূলভিত্তি। গণমাধ্যমের হাত-পা বেঁধে দিলে রাষ্ট্রের জবাবদিহিতা ভেঙে পড়ে।
*নীরবতার রাষ্ট্রে বাংলাদেশ*
আজকের বাংলাদেশ কার্যত এক নীরবতার রাষ্ট্র। শিক্ষক, সাংবাদিক, লেখক কিংবা সাধারণ নাগরিক কেউ ভিন্নমত প্রকাশ করলে আইসিটি আইন ও রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে গ্রেপ্তার হচ্ছে। *অধিকার* সংগঠনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের মার্চের মধ্যে **প্রায় ২,০০০ মানুষকে অনলাইন পোস্টের কারণে গ্রেপ্তার** করা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা গবেষণা ও ক্লাসে স্বাধীনভাবে মতামত দিতে পারছেন না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক “ইউনুস সরকার অবৈধ” মন্তব্য করার পরপরই সাময়িক বরখাস্ত হন। সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল ২০২০ সালে যেমন নিখোঁজ হয়েছিলেন, আজ আবারও একই ধরণের আতঙ্ক সমাজে ফিরে এসেছে।
*জনগণের উপর প্রভাব*
গণতন্ত্র মানে শুধু নির্বাচন নয়; এটি মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, জানার অধিকার ও সরকারের জবাবদিহিতা। কিন্তু এসব ভেঙে পড়ায় জনগণের আস্থা ক্ষয়ে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক জরিপ সংস্থা *গ্যালাপ* এর একটি রিপোর্ট বলছে, ২০২৫ সালের শুরুতে বাংলাদেশের মাত্র **২১% নাগরিক সরকারের প্রতি আস্থা প্রকাশ করেছেন**, যা গত দশকে সর্বনিম্ন।
এতে সামাজিক অস্থিরতার ঝুঁকি বাড়ছে। গ্রামে-শহরে মানুষ ফিসফিস করে বলছে, “রাষ্ট্র আমাদের নয়, রাষ্ট্র এখন ভয় দেখায়।”
*ইতিহাসের শিক্ষা*
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম কারণ ছিল ভিন্নমতের দমন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী প্রথমেই সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের টার্গেট করেছিল। আজকের বাংলাদেশও সেই পথে হাঁটছে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় *সাপ্তাহিক জয় বাংলা* কিংবা *সংবাদ*এর সাংবাদিকরা গোপনে সত্য প্রকাশ করেছিলেন। ইতিহাস সাক্ষী—সত্য কখনো চাপা থাকে না। আজকের দমননীতিও একদিন জনগণের প্রতিরোধ আন্দোলনের জন্ম দেবে।
বাংলাদেশ আজ এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধ কেবল একটি পেশাজীবী মহলের সমস্যা নয়; এটি পুরো জাতির সংকট। গণতন্ত্রের চোখ ও কান হলো সাংবাদিকতা। এই চোখ অন্ধ হলে, এই কান বধির হলে রাষ্ট্র অন্ধকারেই হারিয়ে যাবে।
গণমাধ্যম স্তব্ধ, জনগণের অধিকার ক্ষুণ্ণ বাংলাদেশের গণতন্ত্র তাই আজ মৃত্যুযাত্রায়। প্রশ্ন হচ্ছে, জাতি কি এই অন্ধকার মেনে নেবে, নাকি সত্যের পক্ষে নতুন এক আলোর আন্দোলন গড়ে তুলবে? ইতিহাস আমাদের সামনে সেই দায়ভারই ছুঁড়ে দিয়েছে।