বাংলাদেশে শিক্ষার মান আশঙ্কাজনক হারে নিচে নেমে গেছে। শিক্ষার্থীদের পাঠদক্ষতা, বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান ও বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করার সক্ষমতা গুরুতরভাবে কমে গেছে। আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ডিগ্রির গ্রহণযোগ্যতাও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা ১১ বছর স্কুলে পড়াশোনা করলেও বাস্তবে তারা আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী মাত্র ৬.৫ বছরের সমতুল্য শিক্ষা পাচ্ছে। অর্থাৎ প্রায় সাড়ে চার বছরের ঘাটতি রয়েছে, যা শিক্ষার গুণগত দুর্বলতার বড় ইঙ্গিত।
প্রাথমিক পর্যায়ে অর্ধেক শিক্ষার্থী পাঠ্যবই পড়তেই পারে না, আর মাধ্যমিক শেষে শিক্ষার্থীরা আন্তর্জাতিক মানে এখনো অনেক পিছিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ে ভালো অবস্থানে আসতে পারছে না। দেশে দীর্ঘদিন ধরে সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি চালু থাকলেও বাস্তবে তার কার্যকারিতা নেই বললেই চলে। এমনকি দেশের ১৩ শতাংশ বেকারই স্নাতক ডিগ্রিধারী।
একাধিক আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ, ভারত ও নাইজেরিয়াকে শিক্ষার মানে পিছিয়ে থাকা দেশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে পেরু, ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনাম অনেকটাই এগিয়ে গেছে। বিশেষ করে ভিয়েতনাম প্রাথমিক শিক্ষায় বাংলাদেশের তুলনায় অনেক এগিয়ে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শিক্ষক সংকট, প্রশিক্ষণের ঘাটতি, দুর্বল পাঠ্যক্রম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অস্থিরতা এবং অবকাঠামোর অভাব—সব মিলিয়ে শিক্ষার মান মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রযুক্তিনির্ভর ও দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষায় পিছিয়ে থাকাও বড় কারণ। তাছাড়া প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে শেখ হাসিনার সরকার যে গুণগত পরিবর্তন এনেছিলেন তা ক্ষমতায় এসে বাতিল করে দেয় ইউনুস সরকার। ফলে বড় হোচট খায় শিক্ষা ব্যবস্থা।
ইউজিসি চেয়ারম্যান ড. এস এম এ ফায়েজ বলেন, শিক্ষার মান নিয়ে উদ্বেগ থাকলেও উন্নতির সম্ভাবনা রয়েছে। তবে বাজেট বৃদ্ধি, মেধাবীদের শিক্ষকতায় আগ্রহী করা এবং গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়ানো জরুরি।
বর্তমানে দেশে ১৭২টি বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ে কোনোটি স্থান পায়নি। ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় বিজ্ঞান ও কলা বিভাগে ৯০ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী ফেল করেছে, যা শিক্ষার মানের করুণ চিত্র তুলে ধরে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, তৃতীয় ও পঞ্চম শ্রেণির অধিকাংশ শিক্ষার্থী বাংলা ও গণিতে প্রত্যাশিত দক্ষতা অর্জন করতে পারেনি। মাধ্যমিক পর্যায়েও ইংরেজি ও গণিতে শিক্ষার্থীদের পারফরম্যান্স দুর্বল।
সম্প্রতি সিঙ্গাপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ডিগ্রিকে ‘ফাউন্ডেশন কোর্স’ হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়েছে, যা ডিগ্রির আন্তর্জাতিক মান নিয়ে প্রশ্ন তোলে। এমনকি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ডিগ্রিকে ‘ডিপ্লোমা’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।
ঢাবির অধ্যাপক ড. মনিনুর রশিদ বলেন, শিক্ষানীতির অভাব, ভিশনের অনুপস্থিতি এবং হঠাৎ হঠাৎ কারিকুলামের পরিবর্তনের ফলে দেশ পিছিয়ে পড়ছে। পাশের দেশগুলো যেখানে এগিয়ে যাচ্ছে, সেখানে আমরা স্থবির।
২০০৯ সালে চালু হওয়া সৃজনশীল পদ্ধতি এবং ২০২৩ সালের নতুন কারিকুলাম কাঙ্ক্ষিত ফল দেবার আগেই বাতিল করে দেয় সরকার। ২০২২ সালের সৃজনশীল ইনডেক্সে বাংলাদেশ ছিল ১৩৫টি দেশের মধ্যে ১২৯তম।
শিক্ষার অন্যান্য সূচকেও বাংলাদেশ পিছিয়ে। বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২০তম, উদ্ভাবন সূচকে ১১৬তম এবং দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে নিচে।
অধ্যক্ষ মো. রহমত উল্লাহ মনে করেন, শিক্ষার্থীদের পাঠাভ্যাস গড়ে উঠছে না, শিক্ষকরা প্রস্তুতি ও আন্তরিকতা ছাড়াই ক্লাস নিচ্ছেন। অধিকাংশ শিক্ষক এই পেশায় আসেননি ইচ্ছায়, ফলে দায়িত্বশীলতা কম। মেধাবীদের শিক্ষকতায় আনতে প্রণোদনা বাড়াতে হবে।
মেডিক্যাল শিক্ষায় বাংলাদেশের এক সময়ের খ্যাতি এখন আর নেই। বিশ্ব ফেডারেশন ফর মেডিক্যাল এডুকেশন (WFME) এখনো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। ফলে বিদেশি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কমেছে, এবং দেশের এমবিবিএস ডিগ্রির আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
সর্বশেষ বিবিএস জরিপে দেখা গেছে, দেশের মোট বেকারের মধ্যে ১৩.৫ শতাংশই স্নাতক ডিগ্রিধারী। উচ্চমাধ্যমিক পাস বেকার আরও ৭ শতাংশ। অর্থাৎ প্রতি পাঁচ বেকারের একজন উচ্চশিক্ষিত।
অন্যদিকে, বিশ্বের অনেক দেশ তাদের শিক্ষাক্রমে প্রযুক্তি, বাস্তব দক্ষতা, কারিগরি শিক্ষা, কৃষি ও বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থা যেখানে উদাহরণ হিসেবে ধরা হয়, সেখানে বাংলাদেশের শিক্ষানীতিনির্ধারকদের নজরদারির অভাব স্পষ্ট রয়েছে বলে মনে করছেন সুধীজন।