দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলো যখন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা কাটিয়ে স্থিতিশীলতার পথে এগোচ্ছে, তখন ইউনূস সরকারের সময় বাংলাদেশ মূল্যস্ফীতির ভয়াবহ ফাঁদে আটকা পড়েছে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত দেশে মুদ্রাস্ফীতির হার ৮.২৯ শতাংশে স্থির রয়েছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ।
খাদ্য খাতেই এর মূল চাপ— যেখানে মূল্যস্ফীতি ৯.৩ শতাংশে পৌঁছেছে। এমন সময়েও ভারতের মুদ্রাস্ফীতি ২.০৭ শতাংশ এবং শ্রীলঙ্কার মাত্র ১.৫ শতাংশে নেমে এসেছে। সচেতন লোকজর বলছেন, ইউনূস সরকারের সময়ে অর্থনীতি কার্যত নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় রয়েছে।
শ্রীলঙ্কা অর্থনৈতিক ধস সামলে আজ স্থিতিশীল। পাকিস্তান, নেপাল, এমনকি দীর্ঘদিন ধরে সংকটে থাকা মালদ্বীপ ও ভুটানও মুদ্রাস্ফীতিকে এক অঙ্কে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে জীবনযাত্রার ব্যয় লাগামছাড়া। সরকারের ব্যর্থনীতি পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে।
আন্তর্জাতিক সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) তথ্য বলছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের বার্ষিক গড় মুদ্রাস্ফীতি ছিল ১০ শতাংশ— যা ২০১৩ সালের পর সর্বোচ্চ। ২০২৫-২৬ অর্থবছরেও মুদ্রাস্ফীতি ৮ শতাংশে নামবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হলেও, তা-ও এই অঞ্চলের মধ্যে সর্বোচ্চ হারে রয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ইউনূস সরকারের নীতিগত দ্বৈততা, সময়মতো কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়া এবং বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা এই মূল্যস্ফীতিকে বাড়িয়ে তুলেছে।
একদিকে সুদের হার বাড়িয়ে মুদ্রাসংকোচের কথা বলা হচ্ছে, অপরদিকে অর্থ জোগানে টাকা ছাপানো হচ্ছে। ব্যাংক খাতে তারল্য মেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংক জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে ১.৭ বিলিয়ন ডলার কিনেছে, যার বিপরীতে বিপুল পরিমাণ স্থানীয় মুদ্রা বাজারে ছাড়া হয়েছে— যার সরাসরি প্রভাব পড়েছে পণ্যের দাম বৃদ্ধিতে। একারণে
টাকার মান গত কয়েক বছরে ৪৩ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। এর ফলে আমদানি-নির্ভর অর্থনীতিতে ব্যয় বেড়েছে বহুগুণ, যা ভোক্তা পর্যায়ে সরাসরি মূল্যবৃদ্ধিতে রূপান্তরিত হয়েছে।
তদুপরি, বাজারে কার্যকর তদারকির অভাব, অস্বচ্ছতা ও সিন্ডিকেট-নিয়ন্ত্রিত দাম কাঠামো পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তুলেছে। কৃষকের কাছ থেকে স্বল্প দামে পণ্য কিনেও ভোক্তার কাছে তা বহুগুণ দামে বিক্রি হচ্ছে— ফলে সরকার ঘোষিত কোনো নীতিই সাধারণ মানুষের উপকারে আসছে না।
বিশ্ববাজারে দাম কমলেও দেশে খাদ্য ও জ্বালানির দাম তেমন কমেনি। বরং ২০২৪ সালের বন্যা ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে— যার কারণে শাকসবজি, দুধজাত পণ্য, মাংসসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম চরম পর্যায়ে পৌঁছায়।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, ইউনূস সরকারের সামনে আরও বড় চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাড়ানোর ঘোষণা, নির্বাচনি ব্যয় এবং বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে চাপ— সব মিলিয়ে আগামী বছরেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন হবে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এবং সিপিডি উভয়ই বলছে, ২০২৬ সালেও বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শীর্ষে থাকার আশঙ্কা রয়েছে।
ভারত ও শ্রীলঙ্কার উদাহরণ দেখাচ্ছে— শক্তিশালী মুদ্রানীতি, কার্যকর বাজার তদারকি, এবং উৎপাদনমুখী নীতি গ্রহণ করলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। ভারতে মূল্যস্ফীতি নামিয়ে আনা হয়েছে মাত্র ২.০৭ শতাংশে। শ্রীলঙ্কা ৫০ শতাংশের ওপরে থাকা মূল্যস্ফীতি মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে নামিয়ে এনেছে ১.৫ শতাংশে। কিন্তু বাংলাদেশে ইউনূস সরকারের সময় মূল্যস্ফিতি বাড়ছেই।
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত বাজারে যাচ্ছেন দুশ্চিন্তা নিয়ে। সবজি, মাছ, মাংস, দুধ— সবকিছুর দাম যেখানে আকাশচুম্বী, সেখানে সরকারের আশ্বাস কেবল কাগজেই সীমাবদ্ধ।
অর্থনীতিবিদদের বলছেন, সময়মতো সিদ্ধান্ত না নেওয়ার খেসারত দিচ্ছে দেশের মানুষ। এখন প্রশ্ন একটাই— ইউনূস সরকারের সময়ে মূল্যস্ফীতি যখন দেশের সবচেয়ে বড় সংকটে পরিণত হয়েছে, তখন এর দায় কে নেবে?