দাম বাড়ে। এটা নতুন কিছু নয়। গরম পড়ে, বর্ষা আসে, শীত যায়, রাস্তায় পানি জমে, নদীতে পানি কমে, তারপর দাম বাড়ে। উৎসব এলে বাড়ে, দুর্যোগ এলে বাড়ে, এমনকি রোজা-পূজার সময়ও বাড়ে। কিন্তু যখন দাম বাড়ে মরিচের মতো একটা মসলার, আর সেটা কেজিতে ৩২০ টাকায় গিয়ে ঠেকে, তখন বুঝে নিতে হয় – এটা কোনো প্রাকৃতিক বাজার চক্র না, এটা রাষ্ট্রীয় উদাসীনতার দাম। কাঁচা মরিচের তেজ যখন আগুন ছুঁই ছুঁই করে, তখন মুরগির ডানাতেও আগুন লাগে, মাছের গায়ে জ্বলন্ত সংকটের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ে, আর মানুষের থালায় ভাত কমে যায় – বাড়ে শুধু ক্ষুধা।
যখন প্রতিদিন সবজির বাজারে ঢুকতে হয় গায়ের কাপড় নিয়ে ফেরত আসতে পারবো কিনা সেই চিন্তা নিয়ে, তখন “অস্থির বিশ্ব পরিস্থিতি”, “ডলারের প্রভাব”, “প্রধান উপদেষ্টার অন্ডকোষে ক্যান্সার” — এসব ব্যাখ্যা শোনায় কেবল হিট খরাক্রান্ত গুলতেকীন আহমেদের ফেসবুক স্ট্যাটাসের মতো। কারণ মানুষ বুঝে গেছে, যারা আমাদের শাসন করছে, তারা বাজারে যায় না। তারা শুধু বাজার নিয়ন্ত্রণের নামে চাপাবাজি করে। সেই নিয়ন্ত্রণ চলে দখলদারি পদ্ধতিতে, জবাবদিহি ছাড়াই।
আর এই দখলদারদের নেতার নামই আজ সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হচ্ছে : সুদী মহাজন ইউনুস। তিনি এবং তার অবৈধ দখলদার সরকার – এরা কেবল একদল অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারীই না; তারা দেশের আস্থা, মানুষের জীবিকা, নাগরিকতার মর্যাদা – সবকিছুই জুতো দিয়ে মাড়িয়ে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছেন। যে মানুষ দিয়েই দেশের অস্তিত্ব মূল্যায়ন করা হয়, সেই জনগনের কণ্ঠ যত সহজে ফিকে করে দেওয়া হলো, তার দায়-দায়িত্ব কোলে নিয়ে সেনাবাহিনীর পেছনে লুকোনোর অধিকার কারো নেই। যারা আইন-সংবিধান অগ্রাহ্য করে রাতারাতি শক্তি সংগ্রহ করেছে, তাদের কাছে বাজারের কষ্ট, রোজকার নান্দনিক ক্ষুধা শুধু এক বিস্ময়কর বিস্তারিত — একটা সংখ্যার খেলা মাত্র; আর আমাদের ভাঙা থালা তাদের জন্য কেবলই স্ট্যাটিস্টিক্স এলিমেন্টস।
জুলাই দাঙ্গাতে কী হয়েছিল, আমরা সবাই তা জানি। আমরা দেখেছি কীভাবে বিদেশী রাষ্ট্রের টাকায়, ইসলামিক জেহাদি জঙ্গি সংগঠনের সহায়তায় আর সামরিক বাহিনীর সমর্থনে দেশব্যাপী জুলাই দাঙ্গা বাঁধিয়ে দেশের জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারকে ক্যু করে ফেলে দিয়ে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করা হয়েছিলো, কীভাবে মানুষ মেরে, দেশের সম্পদকে ধ্বংস করে দেশের ইতিহাসের সফলতম সরকারকে বিতর্কিত করা হয়েছিলো। কীভাবে বিদেশী দূতাবাস থেকে রাতারাতি উঠে এসেছে এমন এক সরকার, যাদের জবাবদিহির ক্ষমতা নেই, যাদের জন্মই হয়েছে পেছনের দরজা দিয়ে। কেউ একজনও আসেনি মানুষের ভোটে; সবাই এসেছে পৃষ্ঠপোষকতায়, ষড়যন্ত্রে, বিদেশি ফাইল আর সেনানিবাসের অভ্যন্তরীণ ছায়া-অভিনয়ের সমন্বয়ে। ক্ষমতা তার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে, আর সেই হাতে প্রথম যে কাজটি হয়েছে তা হলো মানুষের গলা টিপে ধরা।
বাজার হলো দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার আয়নাস্বরূপ। সেখানে আজ শুধু দাম নয়, লাঞ্চনা বিক্রি হচ্ছে। তথাকথিত এই অ-সরকার যে ব্যর্থ, সেটা আর বিতর্ক নয়, বরং এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য। কিন্তু তারা যে কতোটা নির্লজ্জ হতে পারে, সেটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। কারণ একদল মানুষ যখন মাস শেষে হিসেব করে, কোনটা কিনবে—মাছ না ওষুধ, কারো ছেলের স্কুলের ফি, অথবা কারো নাতির দুধ—তখন ইউনুসকে রিমজব (যারা জানেন না রিমজব কি, তারা গুগল করুন!) দেয়া মিডিয়ার ক্যামেরা সামনে রাজধানীর বেলতলায়, গুলশানে, বা ধানমন্ডির কাঁচাবাজারে দাঁড়িয়ে কেউ কেউ বলেন, “আহা, দেশের অবস্থা তো মোটামুটি ভালোই!”
এই ভালো থাকার মুখোশটা যেদিন খুলে যাবে সেদিন এই সেনানিবাস বা ইউনুসকে পোষ্য নেয়া দূতাবাসের কি ভয়ঙ্কর অবস্থা হবে তা যে কল্পনাও করতে পারছে না তারা, তা বলাই বাহুল্য। কারণ এই বাজার পরিস্থিতি কোনো বিচ্ছিন্ন অর্থনৈতিক সংকট নয়। এটা সাংবিধানিক ব্যর্থতার প্রতিফলন। যখন সরকার নির্বাচনের অধিকার কেড়ে নেয়, তখন সে শুধু ব্যালট নয়, পেটের ভাতও কেড়ে নেয়। এই বাজার দুঃসহ হয়েছে কারণ একদল মানুষ এখন জানে, তারা চাইলেও এই রাষ্ট্রকে প্রশ্ন করতে পারবে না। কেউ কোনো সাড়া দেয় না, কেউ দায় নেয় না।
মানুষ এখন বাজারে হারে প্রতিনিয়তই আর ইউনুস গুণে গুণে মুনাফা তোলে। যারা ক্ষমতার জোয়ারে ভেসে এসে এই দেশটার কাণ্ডারি হতে বসেছে, তাদের কাছে জনজীবন একধরনের তুচ্ছ হিসেব, যা প্রয়োজন অনুযায়ী বদলানো যায়। তারা আগের সরকারের উন্নয়নের গল্প বলবে, তাদের চালানো মেট্রোরেল চালাবে, ফ্লাইওভারে আলো ঝলকাবে—কিন্তু পেঁয়াজ, মরিচ, টমেটো কেন এত দামি, তার উত্তর দেবে না। তারা ইলিশের হাটে হরিণের দম্ভে দাঁড়িয়ে থাকবে—কিন্তু ভাত-মরিচ দিয়ে খাওয়া গৃহস্থের করুণ মুখের দিকে তাঁকাবে না।
এদেশের গণতন্ত্র এখন মৃত। বাজার তার শবদেহের গন্ধে ভরে গেছে। এই মৃত গণতন্ত্রের ওপর দাঁড়িয়ে রাষ্ট্র এখন দম্ভ করে বলে, “সব ঠিক আছে, এগিয়ে যাচ্ছি।” কোথায় যাচ্ছি? রিকশাচালকের ঘামের ওপর দিয়ে, গৃহবধূর কান্নার ওপর দিয়ে, বাবার অপারেশন পিছিয়ে দিয়ে, শিশুর দুধ না এনে? এগিয়ে যাওয়া যদি হয় কেবল একদল মানুষের লুটপাটের লাইসেন্স, তবে সেই গন্তব্য কোনো রাষ্ট্রের হবার কথা নয়, সেটি দুর্বৃত্তশাসনের কফিন হতে পারে।
আজকের এই বাজারচিত্র আসলে এমন একটা ইন্ডিকেটর যা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে আমরা কী হারিয়েছি, এবং কী হারাতে বসেছি। মরিচ কেজিতে ৩০০ টাকা মানে শুধু পণ্যদ্রব্যের দাম নয়, এটা মানুষের গলার ওপর চাপা পড়া আর্তনাদের একমাত্রিক হিসাব। যে রাষ্ট্র এই চিত্র দেখে না, সে রাষ্ট্র জনগণের নয়—সে রাষ্ট্র এখন কারও একার; হয়তো কারও মঞ্চ, কারও ল্যাব, কারও প্রজেক্ট।
তবুও মানুষ প্রতিদিন বাঁচে, হাসে, কাঁদে, চলে। কারণ মানুষ জানে, তার আর কিছু নেই, থাকার কথা ছিল একটা দেশ। অথচ সেই দেশটা আজ কিছু সংখ্যক লোকের সম্পত্তিতে রূপ নিয়েছে। এই দখলদারি শুধু রাজনীতিতে নয়, বাজারেও, মগজেও, মনেও। আর রাষ্ট্র চুপ করে দেখে, যেন কিছু হয়নি।(সূত্র: আওয়ামীলীগ পেইজ)