বাংলাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে ভয়াবহভাবে বেড়ে গেছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মাত্র ৯ মাসে ৬৬৩ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে শিশু ভুক্তভোগীর সংখ্যা ৩৯৭ জন, যা মোট ঘটনার অর্ধেকেরও বেশি।
অন্তর্বর্তী সরকারের শাসনামলে দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা সম্প্রতি বেড়ে গেছে। মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) মাসিক অপরাধমূলক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রথম ৯ মাসে দেশে ৬৬৩ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে শিশু রয়েছে ৩৯৭ জন।
একাত্তরের মতো এবারও নারী নির্যাতন ও ধর্ষণকাণ্ডে জামায়াত জড়িত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। আর এতে তাদের পুরোপুরি সমর্থন দিচ্ছেন ইউনূস।
নারী নির্যাতন করলে পুরষ্কার দেয় জামায়াত। গত জুনে গণতান্ত্রিক ছাত্র জোটের এক কর্মসূচিতে প্রকাশ্যে এক নারীকে লাথি মারার ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জামিনে মুক্তির পরে ফুলেল শুভেচ্ছা জানায় দলটি।
পুলিশ সদর দপ্তরের মাসিক অপরাধ বিষয়ক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত আট মাসে দেশের বিভিন্ন থানায় নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনায় ১৫ হাজারের বেশি মামলা হয়েছে। সেই হিসাবে গড়ে প্রতি মাসে এক হাজার ৮৭৯টি মামলা হয়েছে। প্রতিদিন মামলা ৬০টির বেশি।
ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে নবম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। হালুয়াঘাট থানার ওসি হাফিজুল ইসলাম বলেন, গত সোমবার রাতে এ ঘটনা ঘটে। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী ও তার পরিবারের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
সম্প্রতি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদে এই তথ্য গেছে। ৮ সেপ্টেম্বর সকালে কুমিল্লার কালিয়াজুরী এলাকায় ভাড়া বাসা থেকে ওই শিক্ষার্থী ও তাঁর মায়ের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
একই মাসে চাঁদপুরে মানসিক ভারসাম্যহীন এক নারীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। ২১ সেপ্টেম্বর রাতে গাজীপুরের শ্রীপুরে শুটিংয়ের কথা বলে রিসোর্টে নিয়ে এক নারী নাট্যকর্মীকে (২৪) দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে।
প্রতিটি সংখ্যার পেছনে আছে একটি জীবন্ত কাহিনি। ১৫ বছরের এক কিশোরীর কান্না, এক বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেয়ের অপূর্ণ স্বপ্ন, কিংবা মানসিক ভারসাম্যহীন এক নারীর অসহায় চিৎকার—এগুলো শুধু পরিসংখ্যান নয়, সমাজের বিবেককে কাঁপিয়ে তোলা ব্যথার ইতিহাস।
এইচআরএএসের প্রতিবেদন বিশ্লেষণে জানা গেছে, গত আট মাসে এক হাজার ৫২২ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ২০ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। ধর্ষণের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করে ৯ জন। এর মধ্যে সর্বশেষ সেপ্টেম্বর মাসে কমপক্ষে ১৫৯ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের শিকার অন্তত ৫৫ জন, যাদের মধ্যে ৩০ জন (৫৪%) ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে এক হাজার ৪৪০, ফেব্রুয়ারিতে এক হাজার ৪৩০, মার্চে দুই হাজার ৫৪, এপ্রিলে দুই হাজার ৮৯, মে মাসে দুই হাজার ৮৭, জুনে এক হাজার ৯৩৩, জুলাইয়ে দুই হাজার ৯৭ ও আগস্টে এক হাজার ৯০৪টি ধর্ষণের মামলা হয়েছে। সব মিলিয়ে গত আট মাসে দেশের বিভিন্ন থানায় মোট মামলা হয় ১৫ হাজার ৩৪টি।
মহিলা পরিষদের চলতি বছরের আগস্টের তথ্য বলছে, আগস্টে দেশে নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে ২২৩ জন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১১৫ জন হত্যা ও ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের ক্ষেত্রে কন্যাশিশুরা সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী। গত সোমবার সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে এ তথ্য তুলে ধরা হয়।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের প্রথম আট মাসে ৫২৭টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২৬৬ জনই শিশু। ধর্ষণের পর ২৬ জনকে হত্যা করা হয়েছে। আত্মহত্যা করেছে ছয়জন। এসব ধর্ষণের ঘটনায় মামলা হয়েছে ৪৩৫টি এবং ৮৭টি ধর্ষণের ঘটনায় করা মামলার তথ্য পাওয়া যায়নি।
মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) প্রকাশিত সেপ্টেম্বরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগস্টে ৪৭টি ধর্ষণের ঘটনা সেপ্টেম্বরে বেড়ে ৫৩টি হয়েছে। এর মধ্যে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ১৩টি এবং ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা তিনটি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব পরিসংখ্যান বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার ব্যর্থতা এবং নারী ও শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রের অক্ষমতার একটি মর্মান্তিক চিত্র তুলে ধরে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় কঠোর আইন প্রয়োগ, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য জরুরি পদক্ষেপ প্রয়োজন। অন্যথায়, সমাজে ভয় ও অরাজকতার এই ঢেউ আরও বিপজ্জনক রূপ নিতে পারে।