আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নাকি প্রতি বছর গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার পাচার হতো—এই অপপ্রচারই গত এক বছর ধরে চালিয়ে যাচ্ছে ড. ইউনূসের সরকার। কিন্তু এত বড় অভিযোগের একটিও অকাট্য প্রমাণ আজ পর্যন্ত কেউ দিতে পারেনি। বরং একটি সাধারণ অঙ্কের মাধ্যমে এই অবাস্তব দাবিকে মিথ্যা প্রমাণ করা যায়।
আমি আগেও ব্যাখ্যা দিয়েছি, আবারও বলছি—প্রতি বছর গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ পুরো আওয়ামী লীগের আমলে (ইউনূসের দাবি অনুযায়ী) যদি ২৩৪ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়ে যেত, তাহলে আজ জিডিপির আকার হওয়ার কথা ছিল ৬৮৪ বিলিয়ন—মানে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হতে হতো বছরে ১০–১১ শতাংশ। অথচ আমরা সবাই জানি, বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী আওয়ামী লীগের আমলে ১৫ বছরে গড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬–৭ শতাংশ হারে।
তার মানে, যদি ইউনূস সত্য বলে থাকে, তবে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এতদিন মিথ্যা বলেছে। এভাবেই প্রমাণিত হয়, ২৩৪ বিলিয়ন ডলার পাচারের দাবি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।
আমরা আজও জানি না, সত্যিই সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় দেশ থেকে কোনো টাকা পাচার হয়েছে কিনা, নাকি এটি কেবল একটি রাজনৈতিক নাটক—জনগণকে বিভ্রান্ত করার কৌশল।
একইভাবে, দেশের ব্যাংকিং সেক্টর ধ্বংসের দায় চাপানো হয়েছিল কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ওপর—যেন তারা একাই অর্থনীতির পতনের কারণ। কিন্তু প্রশ্ন একটাই—সত্যিই কি শেখ হাসিনার পৃষ্ঠপোষকতায় দেশের অর্থনীতি ধ্বংস হয়েছিল, নাকি ড. ইউনূস নিজেই লুটপাট, ঋণ আর অদক্ষতার জালে দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছে?
আসুন এবার মিলিয়ে দেখাই, গত এক বছরে ইউনুস সরকারের বাজেট ও ব্যয়ের বাস্তব চিত্র। এতে স্পষ্ট হয়ে উঠবে, কারা সত্যিই টাকা পাচার করেছে এবং কে আসল দুর্নীতিবাজ। সরকারের বিভিন্ন খাতে ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে ঠিকই, কিন্তু সেই সাশ্রয় জনগণের কাছে পৌঁছায়নি। বরং লুটের টাকায় ভরেছে ক্ষমতাসীনদের পকেট, খালি হয়েছে দেশের ভান্ডার।
গত এক বছরে পণ্য আমদানি কম করায় উল্লেখযোগ্য হারে আমদানি খরচ কমেছে। শিল্পায়নের জন্য প্রয়োজনীয় মেশিনারি ও এলসি সেটেলমেন্ট গত চার বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। অবকাঠামো উন্নয়ন কার্যত স্তব্ধ। জাপানের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হওয়ায় বড় বড় প্রজেক্টগুলো অর্ধসমাপ্ত অবস্থায় পড়ে আছে। দেশের সামাজিক বিনিয়োগেও চলছে ভয়াবহ কাটছাঁট। বিভিন্ন ভাতা, কমিউনিটি ক্লিনিক, স্থানীয় উন্নয়ন প্রকল্প সবই হয় বন্ধ, নয়তো অর্ধেকে নামিয়ে আনা হয়েছে। শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ প্রায় নেই বললেই চলে। অর্থাৎ ব্যয় কমলেও অর্থনীতি স্থিতিশীল হয়নি বরং প্রতিটি খাত দুর্বল হয়েছে।
ড. ইউনুস নিজেই বলেছিলেন, দেশে এক্সপোর্ট ও রেমিট্যান্স বেড়েছে। কিন্তু বাস্তব চিত্র একেবারেই উল্টো। বিভিন্ন গণমাধ্যমের তথ্য বলছে, দেশের বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে। অর্থনীতির যে ভারসাম্য আওয়ামী লীগ সরকার বছরের পর বছর ধরে রেখেছিল, ইউনুস সরকার এক বছরের মধ্যেই তা পুরোপুরি ভেঙে ফেলেছে।
শেখ হাসিনার সময়ে ১৫ বছরে গড়ে প্রতি বছর ৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ যেত অবকাঠামো উন্নয়নে। অথচ ইউনুস সরকারের প্রথম বছরে ঋণ হয়েছে ৯ বিলিয়ন ডলার, কিন্তু কোনো উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন দেখা যায়নি। আরও উদ্বেগের বিষয়, গত এক বছরে দেশিয় ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছে ১,০৪,৬৯০ কোটি টাকা, যা আগের সরকারের তুলনায় ১১% বেশি। ৫৪ বছরে যেখানে মোট আউটস্ট্যান্ডিং লোন ছিল ৯,২৫,০০০ কোটি, সেখানে মাত্র এক বছরে লোন নেওয়া হয়েছে ১,০৪,৬৯০ কোটি টাকা। অথচ অক্টোবর মাসের রিপোর্ট অনুযায়ী ব্যাংকিং সেক্টরে তখনও ১,৯০,০০০ কোটি টাকার লিকুইডিটি ছিল। তাহলে প্রশ্ন উঠে, কেন এত টাকা তুলতে হলো।
এর বাইরেও বিভিন্ন সংস্থা থেকে নতুন করে ঋণ নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছিল। এছাড়া প্রায় ৫২,০০০ কোটি টাকার নতুন মুদ্রা ছাপানো হয়েছে, যা মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি করছে। জনগণের ওপর ভ্যাট ও ট্যাক্সের বোঝা চাপানো হয়েছে। এনার্জি সাপ্লাই ও ইন্ডাস্ট্রিতে ভ্যাট ৩০% পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। ইম্পোর্টের পোর্ট কস্টসহ অন্যান্য ব্যয় বেড়েছে। সাধারণ মানুষ চাপে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান স্থবির। শেয়ার মার্কেট থেকেও লুটপাট হয়েছে প্রায় ৭৫,০০০ কোটি টাকা, যার ফলে বাজারের টার্নওভার ও ভ্যালু ৩৪% কমেছে। বিনিয়োগকারীরা নিঃস্ব, অথচ কিছু প্রভাবশালী গোষ্ঠী অস্বাভাবিকভাবে লাভবান হয়েছে।
এই সব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে পড়েছে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন বন্ধ, দারিদ্র্য বেড়েছে, কর্মসংস্থান নেই, মানুষ না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে। অথচ ইউনুস সরকার ব্যাংক ও জনগণের পকেট থেকে কোটি কোটি টাকা তুলেছে, যার কোনো হিসাব নেই। সম্প্রতি প্রকাশিত এক রিপোর্টে দেখা গেছে, মাত্র এক বছরে বাংলাদেশ থেকে ১৫০ বিলিয়ন ইউরো বিদেশে গেছে। ফিনানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বলছে, ব্যাংক খাতে ঋণসংক্রান্ত সন্দেহজনক লেনদেন বেড়েছে ৬৫ শতাংশ। অর্থাৎ অস্বাভাবিক ব্যাংক ঋণ, রিজার্ভ লুট ও শেয়ার বাজার লুট—সব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতির রক্ত চুষে বিদেশে পাচার করছে ইউনুস সরকার।
তবুও ইউনুস আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনার নামে দুর্নীতির গল্প ছড়িয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করছেন। অথচ বাস্তবতা হলো, গত এক বছরে ঋণ, টাকা ছাপানো, শেয়ার বাজার লুট ও বিদেশে পাচারের পরিমাণ আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বহু গুণ বেশি। এটি শুধু রাজনৈতিক প্রতিশোধ নয়, এটি অর্থনৈতিক ধ্বংসের চিত্র।
জনগণের চোখে ধুলো দেওয়া হচ্ছে, আর আড়ালে লুট হচ্ছে দেশের ভবিষ্যৎ। সত্য ধীরে ধীরে উন্মোচিত হচ্ছে—কে দেশ বাঁচিয়েছে, আর কে দেশ বিক্রি করেছে, তা সবাই দেখতে পাচ্ছে।