বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একসঙ্গে ২৪ জন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাসহ মোট ২৯ জনের বিরুদ্ধে গুম এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। এর মধ্যে ভারতে অবস্থানরত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধান আসামি হিসেবে অভিযুক্ত।
আইনজীবী এবং বিশেষজ্ঞদের মতে, এর আগে কখনো সিভিল কোর্ট বা আইসিটির মতো প্ল্যাটফর্ম থেকে এতো সংখ্যক উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এককভাবে এমন গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়নি, যা দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর রক্ষা ও বিচার বিভাগের আধিপত্যকে নতুন মাত্রা দিয়েছে।
ট্রাইব্যুনালের বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বেঞ্চ গত ৮ই অক্টোবর, সোমবার দুটি পৃথক মামলায় অভিযোগগুলো আমলে নেয়ার পর এই পরোয়ানা জারি করেছে। এর মধ্যে একটি মামলায় শেখ হাসিনা, তার প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা তারেক আহমেদ সিদ্দিক এবং ১৫ জন অন্যান্যের বিরুদ্ধে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের টাস্ক ফোর্স ইন্টারোগেশন (টিএফআই) সেলে বিরোধী নেতাদের গুম করে নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে।
আরেকটি মামলায় শেখ হাসিনা, তারেক আহমেদ সিদ্দিক এবং ১১ জনের বিরুদ্ধে ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স (ডিজিএফআই)-এর জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেল (জেআইসি)-এ একই ধরনের অপরাধের অভিযোগ করা হয়েছে।
প্রসিকিউশনের দাবি অনুসারে, এই ঘটনাগুলোতে পাঁচটি নির্দিষ্ট গুমের কেস উল্লেখযোগ্য, যেখানে ভুক্তভোগীদের ৪৩ দিন থেকে ১ বছর ৬ মাস পর্যন্ত গোপন আটককেন্দ্রে রাখা হয়েছে।
আসামিদের মধ্যে রয়েছে ডিজিএফআই-এর পাঁচজন সাবেক মহাপরিচালক (লেফটেন্যান্ট জেনারেল এবং মেজর জেনারেলসহ), র্যাবের সাবেক প্রধান বেনাজির আহমেদ, এম খুরশিদ হোসেন এবং হারুন-অর-রশিদসহ সেনাবাহিনী থেকে ডেপুটেশনে থাকা ঊর্ধ্বতন অফিসাররা।
প্রসিকিউটররা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসনামলে (২০০৯-২০২৪) নিরাপত্তা বাহিনীগুলো বিরোধীদের গোপন কারাগারে আটকে নির্যাতন করেছে, যা “অ্যান্টি-টেরর” অপারেশনের ছদ্মবেশে সংঘটিত হয়েছে।
ইতিহাসে প্রথম এমন ঘটনা
আইনি বিশেষজ্ঞরা জানান, বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে গুম এবং অতিরিক্ত বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা ঘটলেও, কখনো এতো সংখ্যক (২৪ জন) সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সিভিল কোর্ট বা আইসিটি থেকে একসঙ্গে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়নি।
উদাহরণস্বরূপ, ২০১৪-এর নারায়ণগঞ্জের সাত-গুম কেসে র্যাবের ২৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা হলেও, সেগুলো ছিল ছোট পরিসরে এবং সেনা কর্মকর্তাদের সংখ্যা এতো ছিল না। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ২০২১ সালের প্রতিবেদনে ৬০০-এর বেশি গুমের উল্লেখ থাকলেও, কোনো বড় স্কেলের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছিল না।
জানুয়ারি ২০২৫-এ আইসিটি কয়েকজনের বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি করলেও, এবারকার মতো ২৪ জন সেনা অফিসারের বিরুদ্ধে এককভাবে এটি ঐতিহাসিক।
গুম তদন্ত কমিশনের (অগাস্ট ২০২৪-এ গঠিত) অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে ১ হাজার ৬৭৬-এর বেশি অভিযোগের মধ্যে ৭৫৮টির বেশি নিশ্চিত করা হয়েছে, যা মোট সংখ্যা ৩ হাজার ৫০০ ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
কমিশন জানিয়েছে, “আয়নাঘর” নামক গোপন আটক কেন্দ্রে নির্যাতনের সরঞ্জাম পাওয়া গেছে, এবং শেখ হাসিনাকে “গুমের নির্দেশদাতা” বলে অভিহিত করা হয়েছে।
কমিশনের প্রধান, অবসরপ্রাপ্ত হাইকোর্ট বিচারপতি, বলেছেন, এই অপরাধগুলো পশ্চিমা দেশগুলোর “আন্টি-টেরর” অপারেশনের ছদ্মবেশে সংঘটিত হয়েছে।
সেনাবাহিনীর অবস্থান: সেনাপ্রধান এবং আন্তঃপ্রতিরক্ষা পরিদপ্তর- আইএসপিআর জানিয়েছে, গুমে জড়িত সেনা সদস্যদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে এবং প্রমাণ পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জুলাই মাসে ১০ জন সেনা অফিসারের পাসপোর্ট বাতিল করা হলেও, কেউ কেউ বিদেশ পালিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
আইসিটি-এর অধীনে এই অভিযোগগুলো মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে বিবেচিত, যা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। আসামিরা বর্তমানে পলাতক এবং ট্রাইব্যুনাল ২২শে অক্টোবর আসামিদের আদালতে হাজির করার তারিখ নির্ধারণ করেছে।
ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার এই পদক্ষেপকে “ন্যায়বিচারের প্রতিষ্ঠা” বলে দাবি করলেও, আওয়ামী লীগ এটিকে “রাজনৈতিক প্রতিহিংসা” বলে অভিহিত করেছে।
জাতিসংঘ এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানালেও, তদন্তের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই ঘটনা ২০২৬-এর নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়াতে পারে এবং নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে।
সর্বশেষ, চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেছেন, “এই তদন্ত গুমের ৭০০-এরও বেশি সম্ভাব্য কেসের দিকে এগোচ্ছে।” এই ঐতিহাসিক পদক্ষেপ বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থাকে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করেছে, যা দেশের গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতার জন্য মাইলফলক হয়ে উঠতে পারে।