প্রতিদিনের জীবনযাত্রা, কাজের চাপ কিংবা ব্যক্তিগত দুশ্চিন্তা সব মিলিয়ে মানসিক চাপ যেন জীবনেরই অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অনেকেই মনে করেন, ‘স্ট্রেস’ বা মানসিক চাপ কমাতে দীর্ঘ সময় দরকার। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে মাত্র কয়েক মিনিটেই শরীর ও মনের ভার কমানো সম্ভব।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ‘এলবি হেল্থ’ প্রতিষ্ঠানের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ডা. করিম জে. টরেস সানচেজ রিয়েলসিম্পল ডটকম’য়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলেন, “ডি-স্ট্রেসিং’ হল শরীরের ‘ফাইট অর ফ্লাইট’ বা প্রতিক্রিয়াকে সক্রিয়ভাবে উল্টে দিয়ে শরীর ও মনে থাকা চাপ ও হরমোনের প্রভাব কমানোর সচেতন প্রক্রিয়া।”
অর্থাৎ লক্ষ্য হওয়া উচিত শরীরের স্নায়ুতন্ত্রকে উত্তেজনা থেকে শান্ত অবস্থাতে ফিরিয়ে আনা। যাতে শরীর ও মন ‘রেস্ট অ্যান্ড ডাইজেস্ট’ বা বিশ্রামমুখী অবস্থায় ফিরে আসে।
ক্রমিকভাবে পেশি শিথিল করা
অনেক সময় বোঝা যায় না শরীরের কতটা অংশে চাপ জমে আছে। তাই ডা. টরেস পরামর্শ দেন প্রথমেই শরীরের পেশিগুলো শিথিল করার।
তিনি বলেন, “বসে বা শুয়ে পড়তে হবে। প্রথমে হাত বা পা থেকে শুরু করা জরুরি। যেমন ডান হাতের মুঠো শক্ত করে ধরে রাখা পাঁচ সেকেন্ডের জন্য। এরপর হঠাৎ করে ছেড়ে দেওয়া এবং ১০-১৫ সেকেন্ড গভীরভাবে শরীরের উষ্ণতা ও আরামবোধ লক্ষ্য করতে হবে।”
এভাবে একে একে শরীরের বড় পেশিগুলো হাত, বাহু, মুখ, ঘাড়, কাঁধ, বুক, পেট, কোমর, পা সব অংশে প্রয়োগ করতে হবে একই পদ্ধতি। এই অনুশীলন শুধু শরীরের টান দূর করে না, মনকেও বর্তমান মুহূর্তে ফিরিয়ে আনে।
প্রকৃতিতে ১০ মিনিট হাঁটা
প্রকৃতির মাঝে হাঁটা মানেই মন ভালো হওয়ার সহজ উপায়।
ডা. টরেস বলেন, “চাপ অনুভব করলে জুতা পরে বাইরে বেরিয়ে পড়তে হবে। ছন্দময়ভাবে হাঁটতে হবে এবং অন্তত ১০ মিনিট মনোযোগ দিতে হবে চারপাশের রং, শব্দ ও বাতাসের স্পর্শে।”
এ সময় ফোন বন্ধ রাখাই ভালো। গাছের পাতা, পাখির ডাক, হালকা বাতাস সবকিছুকে অনুভব করার চেষ্টা করা জরুরি। এই অনুশীলন শরীরের পাশাপাশি মনকেও শান্ত করে, কারণ প্রকৃতি আমাদের মানসিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনে।
প্রজাপতি আলিঙ্গন
এই পদ্ধতি সত্যিই এক ধরনের আত্ম-আলিঙ্গন।
ডা. টরেস বলেন, “হাত দুটি বুকের ওপর ‘ক্রস’ বা গুণন চিহ্নর আকারে এমনভাবে রাখতে হবে যাতে প্রতিটি হাতের মধ্যমা অপর কাঁধের ওপর দিয়ে নিচে পড়ে। চোখ বন্ধ করে ধীরে ধীরে শ্বাস নিতে হবে এবং হাত দুটি পালাক্রমে বাম-ডান দিকে টোকা দিতে হবে, যেন প্রজাপতি পাখা মেলছে।”
এক থেকে তিন মিনিট পর্যন্ত এই ছন্দ বজায় রাখলে শরীরের স্নায়ুতন্ত্র শান্ত হয়, উদ্বেগ ও আতঙ্ক কমে এবং নিরাপত্তার অনুভূতি তৈরি হয়।
শরীর ঝাঁকিয়ে নেওয়া
শরীরের মধ্যে জমে থাকা স্ট্রেস কখনও কখনও মুক্তির সুযোগ পায় না।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাইকোথেরাপিস্ট ক্রিস্টিন অ্যান্ডারসন বলেন, “শরীরে চাপ থাকলে তা ঝেড়ে ফেলতে হবে। পাঁচ থেকে ১০ মিনিট মোবাইল ফোনে টাইমার সেট করা যায় এবং হাত, পা, কাঁধ ঝাঁকানো বা একটু নাচা, লাফানো, শরীর নড়াচড়া করা ভালো উপায়।”
তিনি আরও বলেন, “এটা হয়ত প্রথমে অদ্ভুত মনে হবে। তবে এই আন্দোলন শরীরের জমে থাকা উত্তেজনা মুক্ত করে দেয় এবং স্নায়ুতন্ত্রকে শান্ত করে।”
মানসিক গল্প বদলানো
শরীরের পর এবার মনকে শান্ত করার সময়।
ক্রিস্টিন অ্যান্ডারসন বলেন, “মানসিক চাপের বড় অংশ আসে সেই গল্প থেকে, যা নিজের কাছে বলি।
যেমন, ‘আমি পারছি না’, ‘আমার পাশে কেউ নেই’, বা ‘আমি পিছিয়ে যাচ্ছি’। ১০ মিনিট সময় নিয়ে ভাবুন, এর বাইরে আর কী সত্য হতে পারে?”
এই প্রশ্ন মনের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেয়। হয়ত মনে পড়বে, কোনো একদিন সাহসী ছিলেন, কাউকে সাহায্য করেছেন বা কোনো কঠিন সময় পেরিয়ে গেছেন। এমন ভাবনা মনের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং আত্মবিশ্বাস বাড়ায়।
নিরাপদ স্থান কল্পনা
ডা. টরেস বলেন, “মন যদি চিরসঙ্গী হয়, তাহলে সেখানে একটি নিরাপদ জায়গা তৈরি করা উচিত। এটি হতে পারে বাস্তব কোনো জায়গা। যেমন- সমুদ্রতীর, বন বা নিজের প্রিয় ঘর অথবা কল্পনার কোনো স্থান, যেমন- নিরিবিলি ফুলে ভরা বাগান।”
চোখ বন্ধ করে সেই স্থানে নিজেকে কল্পনা করতে হবে। কী দেখছেন, কী শুনছেন, বাতাসে কী গন্ধ পাচ্ছেন! চারপাশের অনুভূতি কেমন তা ভাবতে হবে।
এই চিত্রকল্প অনুশীলন মস্তিষ্কে প্রশান্তি আনে এবং তাৎক্ষণিকভাবে চাপ কমায়।