তিন বছরে দারিদ্র্যের হার ১৮.৭ থেকে লাফ দিয়ে ২৭.৯৩ শতাংশে পৌঁছেছে। অতি দারিদ্র্য প্রায় দ্বিগুণ হয়ে ৯.৩৫ শতাংশ হয়েছে। পিপিআরসির এই সমীক্ষা যে বাস্তবতা তুলে ধরেছে, তা শুধু সংখ্যার খেলা নয়। এর পেছনে লুকিয়ে আছে লাখো মানুষের ক্ষুধা, বেকারত্ব, হতাশা আর অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ।
এই পরিসংখ্যান প্রকাশের সময়টা লক্ষ্য করুন। জুলাইয়ের রক্তাক্ত দাঙ্গা, নির্বাচিত সরকারের পতন, আর তারপর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে তথাকথিত অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতায় আসা। যে মানুষটিকে অর্থনীতির মহাগুরু হিসেবে দেশে-বিদেশে প্রচার করা হয়, যাকে দরিদ্রদের ত্রাণকর্তা বলে জাহির করা হয়, তার আমলেই দারিদ্র্য এতটা বেড়ে গেল। এটা কি কাকতালীয় ঘটনা, নাকি সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের ফসল?
ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংক মডেল নিয়ে বছরের পর বছর ধরে মহিমা কীর্তন করা হয়েছে। নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ক্ষুদ্রঋণের নামে দরিদ্র মানুষকে ঋণের জালে আটকে ফেলার যে কারসাজি, তা দেশের অর্থনীতিকে ভেতর থেকে দুর্বল করে দিয়েছে। সুদের চক্রে ঘুরপাক খেতে খেতে একজন দরিদ্র মানুষ আরও দরিদ্র হয়ে পড়ে। তার সম্পদ বিক্রি হয়ে যায়, জমি চলে যায়, সংসার ভেঙে পড়ে। এই সত্যটা কোনো অর্থনীতির বইয়ে লেখা নেই, কিন্তু গ্রামবাংলার প্রতিটি গলিতে এর জলজ্যান্ত প্রমাণ পাওয়া যায়।
জুলাইয়ের ঘটনাবলী নিয়ে যত প্রশ্নই থাকুক, একটা জিনিস পরিষ্কার। যে অস্থিরতা তৈরি করা হয়েছিল, যে সহিংসতা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, তার পেছনে বিদেশি শক্তির ইন্ধন ছিল। দেশের ভেতরের কিছু মৌলবাদী গোষ্ঠী এবং সামরিক বাহিনীর একটা অংশ এই পুরো নাটকে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিল। আর এই সবকিছুর শেষে মঞ্চে হাজির করা হলো ড. ইউনূসকে। যেন তিনিই একমাত্র ত্রাতা, যিনি দেশকে বাঁচাতে পারবেন। কিন্তু কোত্থেকে বাঁচাবেন? যে সংকট তার নিজের মতাদর্শ আর অর্থনৈতিক দর্শন থেকেই তৈরি হয়েছে?
এই দারিদ্র্যের পরিসংখ্যান আসলে ইউনূসের অর্থনৈতিক চিন্তাধারার দেউলিয়াত্বের প্রমাণ। তিনি যে মডেল দিয়ে দারিদ্র্য দূর করার দাবি করেছেন, সেটা বাস্তবে মানুষকে আরও গভীর দারিদ্র্যে ঠেলে দিয়েছে। যে মানুষটা সুদের মহাজন হিসেবে গরিব মানুষের ঘাড়ে চেপে বসেছেন, তাকে দিয়ে দেশের অর্থনীতি চালানোর পরিকল্পনা যারা করেছেন, তারা হয় চরম বোকা, নয়তো চরম ষড়যন্ত্রকারী।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২২ সালের হিসাব ধরলে, মাত্র তিন বছরে দারিদ্র্য প্রায় দশ শতাংশ বেড়েছে। এর মানে হলো, প্রায় দেড় কোটি মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। এই দেড় কোটি মানুষের জীবনে কী ঘটেছে গত তিন বছরে? মূল্যস্ফীতির চাপে তাদের ক্রয়ক্ষমতা তলানিতে ঠেকেছে। চাকরি হারিয়েছে হাজার হাজার মানুষ। ব্যবসা-বাণিজ্য ধসে পড়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার মাঝে বিনিয়োগ থমকে গেছে। আর এই পুরো সময়টায় যারা ক্ষমতায় এসেছেন, তারা নিজেদের বৈধতা নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন।
ইউনূসের সমর্থকরা হয়তো বলবেন, তিনি তো সবে ক্ষমতায় এসেছেন, তাকে সময় দিতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যে মানুষ চল্লিশ বছর ধরে অর্থনীতি নিয়ে কাজ করছেন, তার তো একটা দৃষ্টিভঙ্গি থাকার কথা। তার নেতৃত্বে এসে অর্থনীতির যে দিকনির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে, তা কি সাধারণ মানুষের পক্ষে, নাকি কর্পোরেট পুঁজি আর বিদেশি দাতাদের পক্ষে? এই প্রশ্নের উত্তর দারিদ্র্যের পরিসংখ্যানেই লুকিয়ে আছে।
যে দেশে নির্বাচিত সরকার থাকার কথা, সেখানে সেনাবাহিনী আর বিদেশি মদদপুষ্ট একটা গোষ্ঠী মিলে অগণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা দখল করেছে। এই ক্ষমতা দখলের বৈধতা দেওয়ার জন্য ইউনূসের মতো একজন আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত ব্যক্তিত্বকে সামনে আনা হয়েছে। কিন্তু সত্য হলো, অবৈধভাবে যে ক্ষমতা আসে, তার ভিত্তি সবসময় দুর্বল থাকে। আর দুর্বল ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে কোনো সরকারই দেশের মানুষের জন্য কল্যাণ করতে পারে না।
ইসলামপন্থী জঙ্গি সংগঠনগুলোর সক্রিয় উপস্থিতি জুলাইয়ের দাঙ্গায় স্পষ্ট ছিল। এই গোষ্ঠীগুলো দেশের ভেতরে একটা বিশেষ ধরনের অস্থিরতা তৈরি করে, যা অর্থনীতিতে সরাসরি আঘাত হানে। বিনিয়োগকারীরা ভয় পায়, পর্যটন শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সাধারণ মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। আর এই পুরো পরিস্থিতিতে যারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তারা হলো দরিদ্র মানুষ। কারণ তাদের কোনো সঞ্চয় নেই, কোনো নিরাপত্তার জাল নেই। একবার আয় বন্ধ হয়ে গেলে তারা সরাসরি দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায়।
বিদেশি রাষ্ট্রের টাকা দিয়ে দেশের ভেতরে অস্থিরতা তৈরি করার ঘটনা নতুন কিছু নয়। বিশ্বজুড়ে এমন অসংখ্য উদাহরণ আছে, যেখানে পরাশক্তিগুলো নিজেদের স্বার্থে দুর্বল দেশগুলোর রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু যেটা অবাক করার মতো, সেটা হলো দেশের কিছু তথাকথিত শিক্ষিত মানুষ, সুশীল সমাজের কিছু অংশ, এমনকি কিছু বুদ্ধিজীবীও এই অবৈধ ক্ষমতা দখলকে সমর্থন দিয়েছেন। তারা হয় বিদেশি স্বার্থের সেবা করছেন, নয়তো রাজনৈতিক সংকীর্ণতায় আক্রান্ত হয়ে নিজেদের বিবেক বিক্রি করে দিয়েছেন।
যে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ দরিদ্র, সেই দেশে দারিদ্র্য বৃদ্ধির মানে হলো সামাজিক বিপর্যয়। অপরাধ বাড়বে, মানুষের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হবে, পরিবার ভেঙে পড়বে, শিক্ষার হার কমে যাবে, স্বাস্থ্যসেবা থেকে মানুষ বঞ্চিত হবে। এই সমস্যাগুলো একে অপরের সঙ্গে জড়িত। দারিদ্র্য শুধু অর্থনৈতিক সূচক নয়, এটা একটা সামাজিক ব্যাধি, যা পুরো জাতিকে পঙ্গু করে দিতে পারে।
ইউনূস যে মডেল অনুসরণ করেন, তা মূলত পশ্চিমা পুঁজিবাদী চিন্তাধারার একটা বিকৃত রূপ। এই মডেলে গরিব মানুষকে ভোক্তা হিসেবে দেখা হয়, উৎপাদনশীল মানুষ হিসেবে নয়। তাদের হাতে ঋণ তুলে দিয়ে মনে করা হয় তারা নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করে নেবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ, বাজার সংযোগ, প্রযুক্তি আর সামাজিক সুরক্ষা ছাড়া একজন দরিদ্র মানুষ শুধু ঋণ দিয়ে কিছুই করতে পারে না। উল্টো সে ঋণের ফাঁদে আটকে যায়।
সামরিক বাহিনীর যে অংশটা এই ক্যু’তে সমর্থন দিয়েছে, তাদের উদ্দেশ্য কী ছিল? তারা কি সত্যিই দেশের কল্যাণ চেয়েছিল, নাকি নিজেদের ক্ষমতা আর সুবিধা সংরক্ষণের জন্য এই পথ বেছে নিয়েছিল? সেনাবাহিনী হওয়ার কথা জনগণের সেবক, দেশের রক্ষক। কিন্তু যখন তারা রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে, যখন তারা ক্ষমতার লোভে অগণতান্ত্রিক পথ বেছে নেয়, তখন তারা নিজেরাই দেশের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।
দারিদ্র্য বৃদ্ধির এই পরিসংখ্যান আসলে একটা সতর্কবার্তা। এটা বলছে যে, যে পথে দেশ এগোচ্ছে, সেই পথ ভুল। যে নেতৃত্ব দেশকে পরিচালনা করছে, তারা জনগণের প্রতিনিধি নয়, তারা অবৈধ ক্ষমতার দখলদার। তাদের হাতে দেশের ভবিষ্যৎ নিরাপদ নয়। এই সত্যটা যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করা যায়, ততই মঙ্গল।
ইউনূসের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলা জরুরি। তিনি কি সত্যিই দরিদ্রদের কল্যাণ চান, নাকি দরিদ্রদের ব্যবহার করে নিজের খ্যাতি আর সম্পদ বাড়াতে চান? গ্রামীণ ব্যাংকের আর্থিক কারসাজির অভিযোগ, সরকারের সঙ্গে দীর্ঘদিনের বিরোধ, আর এখন অবৈধভাবে ক্ষমতায় আসা—এই সবকিছু মিলিয়ে একটা স্পষ্ট ছবি তৈরি হয়। আর সেই ছবি মোটেও সুন্দর নয়।
দারিদ্র্য কমানোর জন্য প্রয়োজন সৎ, জবাবদিহিমূলক এবং জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ সরকার। প্রয়োজন এমন অর্থনৈতিক নীতি, যা সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়নে সরাসরি অবদান রাখে। প্রয়োজন শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা আর কর্মসংস্থানে বিনিয়োগ। প্রয়োজন দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন আর স্বচ্ছ শাসনব্যবস্থা। কিন্তু যে সরকার নিজেই অবৈধ, যার ভিত্তি সহিংসতা আর ষড়যন্ত্রে গড়া, তাদের কাছে এসব প্রত্যাশা করা বোকামি।