ষাট ও সত্তরের দশকের সাবেক শিক্ষার্থী ও একাধিক ভিপি জানান, কলেজের পুকুরঘাটের সামনে পুরনো ভবনের বারান্দা ঘেঁষা শহিদ মিনারটি ষাটের দশকে ভাষা আন্দোলনের শহিদদের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য নির্মিত হয়। তৎকালীন ছাত্র সংসদ এটি নির্মাণ করে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী শহিদ মিনারটি ভেঙ্গে ফেলে। ১৯৭২ সালে কলেজের যুদ্ধজয়ী ছাত্র বীর মুক্তিযোদ্ধারা নিজ উদ্যোগে ও ছাত্র সংসদের অর্থায়নে ছাত্র সংসদের মাধ্যমে পূর্বের স্থানে আবারও কিছুটা সংস্কার করে শহিদ মিনারটি পুননির্মাণ করেন। তাই এই শহিদ মিনারটি একই সঙ্গে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতির প্রতিনিধিত্ব করছে। এক দশক আগে কলেজের পশ্চিমে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর নির্দিষ্ট ডিজাইনে শহিদ মিনার নির্মাণ করলেও ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত শহিদ মিনারটি ভাঙ্গেনি।
জানা গেছে ২০২০ সালে সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্লাটিনাম জয়ন্তী উদযাপিত হয়। এ উপলক্ষে ভাস্কর হামিদুজ্জামানের মাধ্যমে কৃতী শিক্ষার্থী ফলক নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এই খাতে প্রায় ২০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়। ২০২৪ সালে কৃতী শিক্ষার্থী ফলক নির্মাণের জন্য কলেজের শিক্ষকদের একটি অংশ পুরনো শহিদ মিনার ভাঙ্গার প্রসঙ্গ তুললে সাফ না করে দেন তৎকালীন অধ্যক্ষ রজত কান্তি সোম মানস। তিনি জানিয়ে দেন এই শহিদ মিনার ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতির প্রতিনিধিত্ব করছে। স্থানীয় আবেগ এতে জড়িত।
প্রায় ২ মাস আগে কৃতী শিক্ষার্থী ফলকের কাজ শুরু হলে বাস্তবায়নকারী শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর ঘটনাস্থলে গিয়ে কলেজের প্রবেশপথে তোরণের উত্তরের দিকে স্থান নির্বাচন করে। তখন কলেজের অধ্যক্ষ মো. মাহবুবুর রহমান ও শিক্ষক পরিষদের কিছু শিক্ষক এতে বাধা দিয়ে ভাষা আন্দোলনের শহিদদের স্মৃতিতে শ্রদ্ধা জানানোর লক্ষ্যে ষাটের দশকে নির্মিত শহিদ মিনার ভেঙ্গে এখানে কৃতী শিক্ষার্থী ফলক নির্মাণের স্থান দেখিয়ে দেয়।
এসময় প্রকৌশল অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্টরা জানান, এখানে করতে হলে পুরনো স্থাপনা ভাংতে হবে। এ খাতে কোনও বরাদ্দও নেই। কিন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষ সাফ জানিয়ে দেয় নির্মাণ করতে হলে এখানেই করতে হবে। পরে ঠিকাদারকে বলিয়ে পুরনো শহিদ মিনারটি গুড়িয়ে কৃতী শিক্ষার্থী ফলক নির্মাণের কাজ শুরুর সুযোগ করে দেয় কলেজ কর্তৃপক্ষ।
সোমবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে ঐতিহ্যের শহিদ মিনার গুড়িয়ে কৃতী শিক্ষার্থী ফলক করার ছবি ভাইরাল হলে ক্ষুব্দ হয়ে ওঠেন জেলার সর্বস্তরের মানুষজন। সাবেক শিক্ষার্থীরাও প্রতিবাদ জানান। এ ঘটনায় সোমবার দুপুরে সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজ ছাত্রদল অধ্যক্ষ বরাবরে স্মারকলিপি দিয়েছে। অবিলম্বে শহিদ মিনারের স্থানে কাজ বন্ধ রেখে পুরনো শহিদ মিনার পুননির্মাণের দাবি জানিয়েছে তারা। একই সঙ্গে স্থানীয় সুধীজন ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা জেলা প্রশাসককে অবগত করে অবিলম্বে শহিদ মিনারটি রক্ষার দাবি জানিয়েছেন।
বুধবার সকালে গুড়িয়ে দেওয়া শহিদ মিনারের পাদদেশে সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন করে অবিলম্বে শহিদ মিনারটি পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়েছেন। একই সঙ্গে ঐতিহাসিক এই শহিদ মিনার যারা গুড়িয়ে দিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।
স্মারকলিপি প্রদানকারী সরকারি কলেজ ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক বখতিয়ার ইয়াসির নাঈম বলেন, এই শহিদ মিনার শুধু একটি স্থাপনা নয় এটি মহান ভাষা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাসের অংশ। জেলাবাসী, বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীর আবেগ জড়িত। এটি ভাঙ্গা গণঅবজ্ঞার শামিল। অবিলম্বে এটির কাজ বন্ধ রেখে শহিদ মিনারকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে হবে। এ লক্ষ্যে আমরা অধ্যক্ষ স্যারের সঙ্গে কথা বলে লিখিত স্মারকলিপিও দিয়েছি।
ছাত্রদলের জেলা সেক্রেটারি মো. তারেক বলেন, জামায়াত শিবিরের শিক্ষকরা এই ঘটনা ঘটিয়েছে। তারা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবাহী কলেজে থাকুক সেটা চায়না। এ কারণেই তারা ভাষা আন্দোলন ও একাত্তরের স্মৃতি বিজড়িত ফলকটি গুড়িয়ে দিয়েছে। আমরা এ ঘটনায় নিন্দা ও বিচার জানাই।
সুনামগঞ্জের কবি ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নেতা মুতাসিম আলী বলেন, সুনামগঞ্জের প্রথম শহিদ মিনার এটি। পাকিস্তান আমলে নির্মিত হয়েছিল। আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িত এটি। আমাদের আবেগ ও অনুভূতি জুড়ে এর স্থান। মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হানাদাররা এটি ভেঙ্গেছিল। তখন বীর মুক্তিযোদ্ধারা এসে এটি সংস্কার করে পুননির্মাণ করে। এখন স্বাধীন দেশে ঐতিহ্যের শহিদ মিনারটি গুড়িয়ে দিলো কলেজ কর্তৃপক্ষ। এটা ইতিহাস ও স্থানীয়দের প্রতি অবজ্ঞা।
সুনামগঞ্জ শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী কামরুজ্জামান বলেন, এটি নির্মাণের আগে আমি নিজে কলেজে গিয়ে প্রবেশপথের তোরণঘেষা উত্তর দিকে নির্মাণের জন্য প্রস্তাব দিয়েছিলাম। কলেজের শিক্ষক পরিষদ ও অধ্যক্ষ মহোদয় পুরনো শহিদ মিনার ভেঙ্গে ওখানে নির্মাণের স্থান দেখিয়ে দেন। তারাই ঠিকাদারকে বলে পুরনো শহিদ মিনারটি ভাঙ্গিয়েছেন। এখন জেলা প্রশাসকসহ স্থানীয় সুধীজন আমাকে ঐতিহ্যবাহী শহিদ মিনারের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে কাজ বন্ধ রাখার আহ্বান জানিয়েছেন।
কলেজের অধ্যক্ষ মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, নতুন একটি শহিদ মিনার কয়েক বছর আগে নির্মিত হয়েছে। তাই শিক্ষক পরিষদ ও আমরা ওখানে কৃতী শিক্ষার্থী ফলক নির্মাণে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরকে বলি। আমরা এই ঐতিহাসিক শহিদ মিনারটি সম্পর্কে জানতামনা। এখন ভাঙ্গার পর আমরা জানতে পেরেছি। আজ ছাত্ররা স্মারকলিপিও দিয়েছে। সুনামগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সদর উপজেলার সাবেক কমাণ্ডার আব্দুল মজিদ বলেন, ইতিহাসের প্রতি এমন নিষ্টুর আচরণ কাম্য নয়। যারা এটা করেছে তারা ইতিহাস ও ঐতিহ্য বিরোধী। আমরা প্রতিবাদসভা করেছে ডিসির কাছে স্মারকলিপি দিয়েছি। আমরা দোষীদের বিচার চাই ও শহিদ মিনার অবিকল সংস্কার চাই।
বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ১৯৭৪ সালে নির্বাচিত ভিপি সাইফুর রহমান শামছু বলেন, ১৯৬৬ সনে আমি কলেজে ভর্তি হয়ে এই শহিদ মিনার দেখেছি। পরে ১৯৭১ সালে হানাদাররা এটি ভেঙ্গে ফেলে। পরে আমরা যারা কলেজের ছাত্ররা মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলাম তারা এসে আবার শহিদ মিনারটি পুননির্মাণ করি। এটি আমাদের ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতির প্রতীক। এটিকে এভাবে গুড়িয়ে দেওয়া ইতিহাসের প্রতি অবজ্ঞা। অবিলম্বে আমাদের স্মৃতির শহিদ মিনারটি রক্ষা করা হোক।