বাংলাদেশের গ্রাম ও ছোট শহরগুলোতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের উপর মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলোর হুমকি ক্রমশ বেড়ে চলেছে, যার ফলে গানের আসর ও কনসার্ট একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বরং গানের আসর বসানোয় উগ্রবাদীদের হামলা, হুমকিসহ গ্রাম অবরুদ্ধের ঘটনা ঘটছে নিয়মিত।
স্থানীয় সাংস্কৃতিক দলগুলোর পাশাপাশি জনপ্রিয় শিল্পী জেমসের নেতৃত্বাধীন নগর বাউলসহ দেশীয় ব্যান্ডগুলো কনসার্টের অনুমতি পাচ্ছে না, অথচ পাকিস্তানি শিল্পীদের কনসার্ট আয়োজনে কোনো বাধা নেই। এই বৈষম্য সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ব্যাপক উদ্বেগ ও ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উৎসব নানা অজুহাতে বন্ধ করে দেওয়ার অনেক ঘটনা ঘটেছে। লালন উৎসব, বাউল-ফকিরদের মেলা, ওরস, যাত্রাপালা, মঞ্চ নাটক, শরৎ উৎসবসহ বিভিন্ন সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উগ্রবাদীদের হুমকিতে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অথচ থেমে নেই পাকিস্তানি শিল্পীদের আগমন।
মেহেরপুরের স্থানীয় সূর্য ক্লাব গত সেপ্টেম্বরে জেলা স্টেডিয়ামে জেমসের একটি কনসার্ট আয়োজনের পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু স্থানীয় জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপি-এনসিপি-সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোর তীব্র আপত্তি ও হুমকির মুখে জেলা প্রশাসন এই অনুষ্ঠানের অনুমতি বাতিল করে।
ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক নাসিম রানা বাঁধন বলেন, “আমরা সকল নিয়ম মেনে আবেদন করেছিলাম, কিন্তু প্রশাসন বলেছে, মৌলবাদীদের হুমকির কারণে নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব নয়। ফলে কনসার্ট বাতিল করতে বাধ্য হয়েছি।”
এই ঘটনার পর ক্লাবটি ফেসবুকে একটি পোস্টের মাধ্যমে ভক্তদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে, যা হাজার হাজার শেয়ার ও মন্তব্য পেয়েছে।এই ধরনের ঘটনা শুধু মেহেরপুরেই সীমাবদ্ধ নয়। সিলেট, খুলনা, বগুড়া ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন গ্রাম ও গঞ্জে গানের আসর বা কনসার্টের আয়োজন মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলোর হুমকির কারণে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
এদিকে সিলেটের একটি গ্রামে মৌলবাদীরা ‘গানের আসর চললে গ্রাম অবরুদ্ধ করে দেওয়ার’ হুমকি দিয়েছে। ফলে স্থানীয় যুবকদের উদ্যোগে আয়োজিত একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়।
গতকাল শেরপুরে ‘ইত্তেফাকুল উলামা’ নামের একটি উগ্রবাদীদের সংগঠন শেরপুরের বিভিন্ন এলাকায় সহিংস হামলা চালাতে যায় মাদ্রাসার শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের সাথে নিয়ে। তারা জারি গানের আসর বসানোর প্রতিবাদে ভাঙচুর চালান। এসময় সাধারণ গ্রামবাসী তাদের প্রতিহত করেন। এই প্রতিহতের ঘটনায় উগ্রবাদীরা সংঘটিত হয়ে গ্রাম অবরুদ্ধের ঘোষণা দেয়। অথচ প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করেছে এ ঘটনায়।
একইভাবে, ফিডব্যাক, শিরোনামহীন ও পাওয়ারসার্জের মতো জনপ্রিয় ব্যান্ডগুলোর অনুষ্ঠানও একই কারণে স্থগিত হয়েছে।আশ্চর্যজনকভাবে, এই মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলো পাকিস্তানি শিল্পীদের কনসার্টের বিরুদ্ধে কোনো আপত্তি তুলছে না।
সূত্র জানায়, মেহেরপুরে একটি পাকিস্তানি ব্যান্ডের কনসার্ট আয়োজনের জন্য কোটি টাকার বাজেট অনুমোদিত হয়েছে, এবং এতে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়নি। এই বৈষম্য নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করছেন ভক্তরা।
একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী লিখেছেন, “জেমসের মতো দেশের গর্বকে বাধা দেওয়া হচ্ছে, অথচ পাকিস্তানি শিল্পীদের লালগালিচা বিছানো হচ্ছে। এটা কি আমাদের সংস্কৃতির প্রতি অপমান নয়?”
সাংস্কৃতিক কর্মীরা এই পরিস্থিতিকে দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উপর হুমকি হিসেবে দেখছেন। বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক ফোরামের এক সদস্য বলেন, “গান আমাদের মুক্তির সংগ্রামের একটি অংশ ছিল। এখন সেই গান বন্ধ করার চেষ্টা আমাদের স্বাধীনতার মূল্যবোধের উপর আঘাত।”
জেমস নিজে এই ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, “গান আমাদের হৃদয়ের ভাষা। এটাকে বন্ধ করার চেষ্টা শুধু আমার নয়, পুরো যুবসমাজের স্বপ্নের উপর আঘাত। আমি ভক্তদের পাশে আছি।”
অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ব্যাস্ত আছেন জুলাই তথ্যচিত্র নির্মানে, গুম কমিশন এর কাল্পনিক টেলিফিল্ম নির্মানে। এই গানের আসর বন্ধের ব্যাপারে তার মতামন জানতে চাওয়ায় উনি ফোন কেটে দেন।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, যদি এই মৌলবাদী প্রভাব রোধ না করা যায়, তাহলে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও যুবসমাজের সৃজনশীলতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।