রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আমদানি কার্গো ভিলেজে গতকাল বিকেলে এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বাংলাদেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রূপপুরের জন্য রাশিয়া থেকে আমদানি করা ১৮ টন মূল্যবান সরঞ্জাম সম্পূর্ণভাবে পুড়ে ছাই হয়েছে।
এই ঘটনায় মোট ক্ষতির পরিমাণ কয়েকশ কোটি টাকার বেশি হতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে, যা দেশের সামগ্রিক বাণিজ্য ও লজিস্টিক শৃঙ্খলায় বড় ধাক্কা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
আগুনের কারণ এখনও তদন্তাধীন, যদিও কর্তৃপক্ষ নাশকতার সম্ভাবনা অস্বীকার করছেন।
জানা গেছে, আগুন লেগেছিল বিমানবন্দরের ৮ নম্বর গেটের কাছে অবস্থিত কার্গো ভিলেজের একটি গুদামে, যেখানে বিভিন্ন আমদানি পণ্য মজুত থাকে। দুপুর সোয়া ২টার দিকে আগুনের সূচনা হয় এবং এর তীব্রতা এতটাই ছিল যে, আশপাশের গুদামগুলোতেও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের ১৩টি স্টেশন থেকে মোট ৩৭টি ইউনিট নিয়ে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া গ্রহণ করা হয়। পরবর্তীতে বিমানবাহিনী, সেনাবাহিনী এবং বিজিবির ২টি প্লাটুন যোগ দিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সহায়তা করে। রিমোট কন্ট্রোলড ফায়ারফাইটিং রোবটও ব্যবহার করা হয়েছে। প্রায় ৬ ঘণ্টার সংগ্রামের পর রাত ৮টার দিকে আগুন সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণে আসে।
এই অগ্নিকাণ্ডে আহত হয়েছেন ১৭ জন, যাদের মধ্যে কয়েকজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। কোনো প্রাণহানির খবর পাওয়া যায়নি। তবে, আগুনের তীব্রতায় বিমানবন্দরের সব ধরনের ফ্লাইট সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়, যা আন্তর্জাতিক যাত্রীদের অসুবিধায় ফেলে।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে পরিস্থিতির রিপোর্ট নেন এবং দ্রুত পুনর্বাসনের নির্দেশ দেন।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো, আগুনে পুড়ে যাওয়া সরঞ্জামগুলোর মধ্যে ছিল রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দ্বিতীয় ইউনিটের জন্য রাশিয়ার রোস্যাটম কর্পোরেশন থেকে আমদানি করা ১৮ টনের নিউক্লিয়ার ফিউেল হ্যান্ডলিং সিস্টেমের অংশ। এই সরঞ্জামগুলো তেজস্ক্রিয় পদার্থ নয়, তবে কেন্দ্রের নিরাপত্তা ও কার্যকারিতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
রূপপুর প্রকল্পের সূত্রে জানা গেছে, এগুলো গত সপ্তাহে বিশেষ কার্গো ফ্লাইটে রাশিয়া থেকে আনা হয়েছিল এবং কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সের অপেক্ষায় গুদামে মজুত ছিল। এখন এই ক্ষতির কারণে প্রকল্পের সময়সূচিতে বিলম্ব হতে পারে, যদিও রোস্যাটমের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা চলছে।
ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক এম কে জাকির হাসান বলেন, “কার্গো ভিলেজে অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা ভালো, কিন্তু এই ঘটনা আমাদের জন্য একটি শিক্ষা। এখানে আরও ফায়ার হাইড্রেন্ট এবং সরঞ্জাম যোগ করতে হবে। আগুনের কারণ তদন্তে বেরিয়ে আসবে, তবে নাশকতার কোনো ইঙ্গিত নেই।”
তিনি আরও জানান, বিমানবন্দরের মূল অংশ ক্যাটাগরি-৯ স্তরের অগ্নিনির্বাপণ সুবিধায় সুরক্ষিত, কিন্তু কার্গো এলাকায় সীমাবদ্ধতা ছিল।
অন্তর্বর্তী সরকারের এক কর্মকর্তা বলেন, “এই ঘটনা শুধু আর্থিক ক্ষতি নয়, বরং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক আস্থায় ধাক্কা। কার্গো হ্যান্ডলিং বন্ধ থাকায় প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার আমদানি-রপ্তানি আটকে যাচ্ছে।”
বিশেষজ্ঞরা মত প্রকাশ করেছেন, এমন ঘটনা বিমানবন্দরের নিরাপত্তা মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে এবং দ্রুত তদন্তের দাবি জানিয়েছেন।
রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো প্রকল্প, যার মোট বিনিয়োগ ১২.৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। রাশিয়ার সহায়তায় নির্মিত এই কেন্দ্রে দুটি ভিভিইআর-১২০০ রিয়্যাক্টর থাকবে, যা ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। প্রথম ইউনিট চালু হওয়ার লক্ষ্য ছিল ২০২৪-এর শেষে, কিন্তু এখন এই ক্ষতি সেই সময়সূচিকে আরও পিছিয়ে দিতে পারে।
রোস্যাটমের সঙ্গে যোগাযোগ করে নতুন সরঞ্জাম আমদানির ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, তবে এতে অতিরিক্ত খরচ ও সময় লাগবে।
এই অগ্নিকাণ্ড দেশজুড়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার সঙ্গে যুক্ত হয়ে উদ্বেগ বাড়িয়েছে। কয়েকদিন আগে মিরপুরের রূপনগরে একটি গুদামে ১৬ জনের মৃত্যু ঘটেছে। এছাড়াও চট্টগ্রাম ইপিজেড, নারায়ণগঞ্জে একটি চিনিকলসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি কারখানা আগুনে ভস্মীভূত হয়েছে গত কিছুদিনের মধ্যে।