মনজুরুল হক
According to military proverb- ‘winning a war without arms!’ গত পনের মাস ধরে সেনানিবাসে বিগত সরকার পতনের ‘অন্যতম কুশিলব’ জেনারেল ওয়াকার, বাহিনীতে তার সমর্থীত অংশ, ইন্টেরিম সরকারপ্রধানের সঙ্গে ‘শত্রু শত্রু খেলা’, গত সরকারপন্থীদের কোণঠাসা করা, র্যাডিক্যাল ইসলামপন্থী তথা বিএনপি- জামাত- ইউনূস- এনসিপিপন্থী অংশের ভেতর যে সাউন্ডলেস ‘টাগ অব ওয়ার’ চলছিল তাতে জয়ী হলেন জেনারেল ওয়াকার। যে পদ্ধতিতে হলেন তার নাম দেয়া যেতে পারে―’আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা’।
📍
এক্তিয়ারবর্হিভূত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ও তাদের জারিকৃত বিশেষ অর্ডিন্যান্সবলে বিগত সরকারের আমলে গুম-খুন-আয়নাঘরে নির্যাতন ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে দায়েরকৃত তিনটি মামলায় ২৫ জন সেনা কর্মকর্তার নামে ওয়ারেন্ট ইস্যু করেছিল। সেনাসদর অভিযুক্তদের আদালতে না পাঠিয়ে সেনা হেফাজতে রেখেছিল। ধারণা করা হচ্ছিল তারা নিজস্ব আইনবিদের পরামর্শে ICT’র ওয়ারেন্ট চ্যালেঞ্জ করবেন। আরও ধারণা করা হচ্ছিল সেনাবাহিনীর সুনাম রক্ষার্থে অধিকাংশ সেনা কর্মকর্তাদের ক্ষোভ প্রশমিত করতে ওয়াকার নিজের ‘মধ্যপন্থী’ ইমেজ ধরে রাখতে ইন্টেরিম প্রধানের সঙ্গে সমঝোতা করে একটা সুরাহা করবেন। তা হয়নি। নির্দিষ্ট দিনে, অর্থাৎ ২২ অক্টোবর অভিযুক্তদের ১৫জনকে আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে। আতদালত তাদের সকলকে সেনানিবাসের ‘সাব জেলে’ পাঠিয়েছেন। তার আগে অভিযুক্তদের চাকরি থেকেও অব্যহতি দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ এক অর্ডিন্যান্সবলে তারা এখন বরখাস্তকৃত সেনা অফিসার!
📍
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে জেনারেল ওয়াকার এই পরিস্থিতি এড়াতে পারতেন কীনা? উত্তর খোঁজার আগে বুঝতে হবে তিনি আদৌ এড়াতে চেয়েছেন কীনা? ঘটনাপ্রবাহ বলে তিনি এড়াতে চাননি! অর্থাৎ তার দাবাবোর্ডের সাদা ঘোড়া আড়াই চালে কালো রাজাকে খেয়ে দিয়েছে।
📍
তাকে যারা নিরপেক্ষ, লীগের প্রতি সফট, শেখ হাসিনাকে সেফ একজিট দিয়েছেন, ইন্টেরিমের ‘ব্লাডি’ করিডোর দেয়ার বিরোধীতা করেছেন, ডিসেম্বরেই নির্বাচন চেয়েছিলেন, একাধিক বিচারকসহ লীগের শীর্ষ নেতাদের সেফ একজিট দিয়েছেন, একাধিকবার ভারতের সেনা প্রধান উপেন্দ্র দ্বিবেদীর কথা বলে পরামর্শ নিয়েছেন, তারা এবার পয়সার উল্টো পিঠ দেখে নিতে পারেন।
📍
(১) ৫ আগস্ট কার্ফিউ ব্রেক করে গণভাবন ঘিরে শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে উদ্যত মবকে প্রতিহত করতে আদেশ দেননি ওয়াকার। বরং ব্যারিকেড খুলে এনএসএফ সরিয়ে নেন।
(২) ৩ আগস্ট বলে দেন- ‘সেনারা ছাত্রদের ওপর গুলি চালাবে না’। ৪ঠা আগস্ট মধ্যরাত পর্যন্ত শেখ হাসিনাকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন―’আমার ওপর আস্থা রাখুন, কিছুই হবে না, আমরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো, আপনার সুরক্ষার দায়িত্ব আমার জিম্মায়। ‘
(৩) ভারতের এন এস এ অজিত দোভাল ও সেনাপ্রধান উপেন্দ্র দ্বিবেদীর ফোন পেয়ে সেনারা যখন শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার ব্যবস্থা করছেন, তখন তিনি জামাতের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করছেন।
(৪) ৫ আগস্ট তিনি ঘোষণা দিয়ে জাতির দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিলেন। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকে সবার আগে ডাকলেন জামাতকে, ভাষণেও জামাতের নাম আগে বললেন। অভ্যেসবশত ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী’ বলে পরক্ষণেই সংশোধন করে শুধু ‘প্রধানমন্ত্রী’ বললেন।
(৫) ৮ আগস্ট মুহাম্মদ ইউনূসকে বিমানবন্দরে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় রিসিভ করলেন। প্রেসিডেন্টকে দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের যাবতীয় ফর্মালিটিজ সম্পন্ন করলেন। ইউনূসের ব্যক্তিগত পছন্দের লোকজন নিয়ে গড়া সরকারকে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে ইউনূসের পক্ষ নিলেন। তার পর থেকে সরকারের সকল কাজের সমর্থন দিলেন।
(৬) ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার থাকার পরও তাঁর চোখের সামনে দেশে চলল অভূতপূর্ব নৈরাজ্য। সারা দেশে লীগসহ ১৪ দলের নেতা-কর্মীদের হত্যা-জখম-গ্রেফতার-জেল-জুলুম চলল। ১৫ আগস্টের পর বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাড়ি ভাংচুর-অগ্নিসংযোগ থেকে শুরু করে সারা দেশের মুক্তিযুদ্ধের, স্বাধীনতার, সেক্যুলারিজমের প্রতীক সকল ভাস্কর্য-ম্যুরাল-মূর্তি-অবকাঠামো ধ্বংস করায় কোনও বাঁধা দিলেনই না, কোথাও কোথাও সেনা সদস্যরাও এসব ভাংচুরে সামিল হলেন। তিনি নির্বিকার।
(৭) ২৬ ফেব্রুয়ারি প্রাক্তন সেনা কর্মকর্তাদের সামনে এক ভাষণে ‘আই হ্যাড এনাফ ইজ এনাফ’ বলে জাতির বিবেকের ভূমিকা নিলেন। এরই মধ্যে ইউনূস সরকার ও এনসিপি তাকে এবং প্রেসিডেন্টকে একাধিকবার সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলেও তিনি নির্বিকার। তিনি রাশিয়া সফরকালিন ইউনূস খলিলুর রহমানকে ‘জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্ট’ নিয়োগ দিলেন। যার প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট-‘ওয়াকারকে সরিয়ে দেওয়া’। এরই উপাদান হিসাবে এনসিপি ও এবি পার্টির নেতা তাঁকে বিশ্রীভাষায় কটুক্তি করল, তিনি অসীম ধৈর্যের প্রতিমূর্তি হয়ে নীরব থাকলেন।
(৮) যমুনাতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মুহাম্মদ ইউনূসের দফায় দফায় বৈঠক হল। জামাত নেতারা ছুঁটলেন সেনাপ্রধানের ডাকে সেখানে বৈঠক করতে। বৈঠকের খবর প্রকাশ হলো না দুই দিনেও। ইউনূসের ‘পদত্যাগ নাটক’ শেষ হলে ওয়াকার ২২ মে আল্টিমেটাম দিয়ে মনে করলেন ‘ডোজটা কি কড়া হয়ে গেল!’ তাই ড্যামেজ কন্ট্রোল করতে জামাতের সঙ্গে বৈঠক করলেন। আইন করে আওয়ামী লীগ আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত সচিব-কর্মকর্তাদের খেদিয়ে ছাত্রদের মধ্য থেকে কর্মকর্তা নিয়োগ, লীগ আমলের চাকরিতে যোগ দেওয়া সেনা কর্তাদের চাকরিচ্যুতি, জামাতের নেতা এটিএম আজাহার বিশেষ আদালতে ফাঁসির দণ্ড মওকুফ এবং বেকসুর খালাস-তিনি কিন্তু নির্বিকার।
📍
মুহাম্মদ ইউনূস আমেরিকান ডিপস্টেটের মনোনীত ‘পাপেট’। ডিপস্টেট ওয়াকারের সমর্থন ছাড়া একজন সিভিলিয়ানকে ক্ষমতায় বসাতে পারে না। সুতরাং ইউনূসকে বসানো, তাকে দিয়ে ডিপস্টেটের পারপার্স সার্ভ করার সকল প্ল্যানে ওয়াকারও ‘তাদের লোক’। ইউনূস-ওয়াকার দ্বন্দ্ব দৃশ্যমান দেখালেও দিন শেষে বৈরীতা নেই। ইউনূস ভারতকে খুঁচিয়ে পাবলিক সেন্টিমেন্ট উসকে দিয়ে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের কার্ড খেলে নির্বাচন অনিশ্চিত করে ডিপস্টেটের অসমাপ্ত কাজগুলো করবেন। সেটাকে ‘কাভারআপ’ করবেন ওয়াকার ভারতকে আস্থায় রেখে, ভারতের সেনাপ্রধানের সঙ্গে সুসম্পর্ক ধরে রেখে। কার্যত দুজনের স্বার্থ এক এবং অভিন্ন। দুজনেই ডিপস্টেটের প্রিয়পাত্র।
📍
ওয়াকার বহুবার বলেছেন-‘তাঁর কোনও রাজনৈতিক অভিলাষ নেই’। এই কথাটি বারে বারে প্রচার করার মানে হলো অবশ্যই উচ্চাভিলাষ আছে। ধরা যাক ২৬-এর ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হলো না। দেশে একটা গৃহযুদ্ধের সিচ্যুয়েশন তৈরি হল। সব কিছু পিছিয়ে গেল অনির্দিষ্টকাল। ইতোমধ্যে ২০২৭ সালের ২২ জুন ওয়াকারের সেনাপ্রধানের মেয়াদ শেষ হবে। তখন তিনি ইউনূস ও এনসিপি মিলে বিএনপি-জামাতের পর তৃতীয় বৃহত্তম দল গড়লেন। হতে পারে না? রাজনীতিতে শেষ বলে এবং ভ্যাকিউম বলে কিছু নেই। প্রধানমন্ত্রীর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার থাকাকালিনই তিনি রাজনীতির হাতি-ঘোড়া, উজির-নাজির সব্বাইকে দেখেছেন। তাতে করে এই সম্ভবনাটি উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
📍
দেশপ্রেম, দেশ রক্ষার শপথ, স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, সাম্য, ন্যায়বিচার, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, এসব আবেগমিশ্রীত ব্যুরোক্র্যাটিক টুলস মাত্র। টাকা এবং ক্ষমতার পাল্লায় এসব মূল্যহীন। হিউম্যান ফিলোসফির অন্যতম কাঙ্খিত লক্ষ্যটির নাম-ক্ষমতা। সেটা যদি রাষ্ট্রক্ষমতা হয় তাহলে এর সঙ্গে অন্য কোনোকিছুর তুলনা চলে না। ‘পাকিস্তানের আদলে’ গড়ে ওঠা বাংলাদেশের সেনাবাহনীর শীর্ষ কর্তারা যে রাষ্ট্রক্ষমতা প্রত্যাশী সেটা এদেশে অনেকবার প্রমাণিত। রাজনীতি ‘অ’-‘আ’ পড়তে পারা মানুষও জানেন জেনারেল ওয়াকার সমর্থন তুলে নিলে মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার এক মুহূর্তও টিকবে না।
📍
১৫ সেনা অফিসারদের জেলে পাঠানোর পরের ঘটনাবলি সম্পর্কে এখনই অনুমান করা যাবে না। তবে ইন্টেরিম যেমনটা সাজিয়ে রেখেছে সব সেভাবেই ঘটবে মনে করার কারণ নেই।
📍
প্রথমতঃ যে সাত র্যাব সদস্যের শাস্তির রেফারেন্স টানা হচ্ছে তাদের অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত ছিল। এখন অভিযুক্তদের যে অপরাধে জেলে দেওয়া হলো সেই একই অপরাধে ২০০৪ সালে গঠিত র্যাব-এর এক্সট্রা জ্যুডিশিয়াল কিলিং, অপারেশন ‘ক্লিনহার্ট’, ২০০১ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত RAB, DGFI, SB, DB, তথাকথিত ‘বাংলাভাই’কে সমর্থন দেয়া সেনা-পুলিশ কর্মকর্তারাও কেন অপরাধী হবেন না সেই প্রশ্ন উঠবে না কেন? চাকরিরত অবস্থায় শপথ ভঙ্গ করে বিগত সরকারবিরোধীতাও কেন অপরাধ বিবেচিত হবে না? ২০২৪ জুলাই-আগস্টের ঘটনাবলির কারণে সেনা কর্তারা দোষী সাব্যস্ত হলে তাদের কমান্ডিং অফিসার হিসাবে সেনাপ্রধান কেন অভিযুক্ত হলেন না? কোনোভাবে বিগত সরকার একজিস্ট করলে একজিস্টিং সরকারের বিপক্ষে গিয়ে বিক্ষোভকারীদের পক্ষ নেওয়ায় বরং ওয়াকার পদ হারাতে পারতেন।
📍
দেশের ইতিহাসে ২০০১ সালের নির্বাচনে পরাজিত আওয়ামী লীগ প্রথমবারের মত শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিল। তা বাদে দেশে যতোবার সরকার বদল হয়েছে, তার সবগুলো ক্ষেত্রে সেনাবাহিনী জড়িত ছিল, যা সংবিধানের ৭ম সংশোধনীবলে রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধ। ইতিহাসের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী জনগণের ট্যাক্সের টাকায় সর্বোচ্চ সুবিধাপ্রাপ্ত জীবন-যাপন করলেও কখনও জনগণের পক্ষে কাজ করেনি। ধর্মাশ্রয়ী কূপমণ্ডূকতা, সেনা কালচার ছাপিয়ে ধর্মবিশ্বাসের চর্চা করা ‘দুধের মাছি’ এই সেনাবাহিনীর হাতে দুজন রাষ্ট্রপ্রধানসহ অসংখ্য রাজনৈতিক নেতৃত্ব, সাধারণ জনগণকে প্রাণ দিতে হয়েছে। এমন একটা বাহিনীর একাংশকে নিজেদের জিঘাংসা মেটানোর জন্য কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে একইরকম অপরাধ আমলে না নেওয়া আইনের ব্যত্যয়।
📍
১৫ সেনা কর্মকর্তাদের জেলে নেওয়ার পরবর্তীতে সেনানিবাসে কী ঘটতে পারে সেটা জনগণ অনুমান করতে পারবে না, তবে সাধারণভাবে অনুমান করা যায় দেশরক্ষা বাহিনীর ভেতর দেশের প্রতি, চেইন অব কমান্ডের প্রতি যতটুকু কমিটমেন্ট ছিল তাতে চিড় ধরবে। গত পনের মাসে নিখুঁত ছক কষে সেনাবাহিনীকে দলাদলিতে লিপ্ত করিয়ে দুর্বল ও বিশৃঙ্খল করা হয়েছে। এবার সেনা-পুলিশ কর্মকর্তাদের জেলে ঢুকিয়ে কফিনে শেষ পেরেকটি ঠোকা হলো। এর উদ্দেশ্য যদি ‘দেশ রক্ষার বিশেষ মিলিশিয়া বাহিনী’ গঠন করা হয় (যা প্রায়শই কয়েকজন উপদেষ্টা বলেন) তাহলে বুঝে নিতে হবে দেশের সামনে ঘোরতর দুর্বিপাক ঘনিয়ে আসছে। যা বাংলাদেশকে ইরাক-সিরিয়া-লিবিয়ার চেয়েও ভয়াবহ রুয়ান্ডার কাতারে নিয়ে ফেলবে, এবং বিদ্যমান দলগুলোর পক্ষে দেশ বাঁচানো সম্ভব হবে না, কেননা তারাই এসবের হোতা।
