একটা দেশে প্রতিদিন গড়ে এগারোটা খুন হচ্ছে। এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছি আমরা। আর এই ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে ঠিক কাদের হাত ধরে, সেটা এখন আর গোপন কিছু নয়।
গত বছরের জুলাইয়ে যে তাণ্ডব শুরু হয়েছিল, তার পেছনে কারা ছিল সেটা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। বিদেশি অর্থায়ন, চরমপন্থী গোষ্ঠীর মদদ আর সামরিক বাহিনীর কোনো এক অংশের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থন নিয়ে একটা নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করা হলো। যতই তারা বলুক এটা জনগণের আন্দোলন ছিল, সত্যিটা হলো এটা ছিল সুপরিকল্পিত একটা ক্যু। আর সেই ক্যুয়ের নেতৃত্বে এসেছেন মুহাম্মদ ইউনূস, যাকে দেশের মানুষ সুদী মহাজন বলেই চেনে। পাশে দাঁড়িয়ে আছেন সেনাপ্রধান ওয়াকার।
যে দেশে একদিনে চুয়াল্লিশজন পুলিশ সদস্যকে হত্যা করা হয়, থানাগুলোতে আগুন দেওয়া হয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে পুরোপুরি অচল করে দেওয়া হয়, সেই দেশে খুন বাড়বে না তো কী কমবে? যাত্রাবাড়ী, উত্তরাসহ একাধিক থানা পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া হয়েছিল। পুলিশকে এমনভাবে ভয় দেখানো হয়েছিল যে তারা নিজেদের নিরাপত্তার জন্যই সেনাবাহিনীর আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। এখন পর্যন্ত থানাগুলো সেনা প্রহরায় চলছে। এটাই বাস্তবতা।
আর এই বাস্তবতা তৈরি করেছেন কারা? যারা ক্ষমতায় এসেছেন সহিংসতার মধ্য দিয়ে, তারাই কীভাবে সহিংসতা কমাবেন? যে হাত দিয়ে আগুন জ্বালানো হয়েছে, সেই হাত দিয়ে কি সেই আগুন নেভানো সম্ভব? ইউনূস আর ওয়াকারের নেতৃত্বাধীন এই অবৈধ সরকারের কাছ থেকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি আশা করাটা হাস্যকর।
পুলিশকে এখন প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারেও বিধিনিষেধ দেওয়া হয়েছে। পরোয়ানাভুক্ত আসামি ধরতে গিয়ে পুলিশই হামলার শিকার হচ্ছে। এটা কোন দেশ, কোন সরকারের আমলে হয়? যে সরকার নিজেই অবৈধভাবে ক্ষমতায় এসেছে, তারা কীভাবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করবে? যে লোকগুলো নিজেরাই রাষ্ট্রযন্ত্র ভেঙে ক্ষমতায় বসেছে, তাদের কাছ থেকে রাষ্ট্রযন্ত্র ঠিক করার আশা করা বোকামি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক যা বলেছেন, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছেন, জুলাই দাঙ্গার পর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। আইনি কাঠামো বাস্তবায়নে ঘাটতি রয়েছে। বিচার নিশ্চিত হচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের ভূমিকা পালন করতে পারছে না। আর সবচেয়ে বড় কথা, অপরাধীরা রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় পাচ্ছে।
এটাই তো স্বাভাবিক। যারা নিজেরাই সহিংসতার মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে, তারা কি অন্য সহিংস লোকদের শাস্তি দেবে? বরং তারা তো চাইবে একটা ভয়ের পরিবেশ তৈরি থাকুক। মানুষ যেন মুখ খুলতে না পারে, প্রতিবাদ করতে না পারে। সাক্ষী হতে ভয় পায়। এই ভয়ের রাজত্বে তারা নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে চায়।
গত বছর সারা দেশে তিন হাজার চারশো বত্রিশটা খুনের মামলা হয়েছিল। এ বছর মাত্র নয় মাসেই হয়েছে দুই হাজার নয়শো এগারোটা। হিসাবটা বুঝতে কি খুব বেশি বুদ্ধির দরকার? দৈনিক গড় গত বছর ছিল নয়টা খুনের মামলা, এখন সেটা প্রায় এগারো। শুধু ঢাকা মহানগরেই এ বছরের নয় মাসে ঘটেছে তিনশো বায়ান্নটা খুন, যেখানে গত পুরো বছরে ছিল তিনশো ঊনচল্লিশটা।
মুহাম্মদ ইউনূসের মাইক্রোক্রেডিট নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। গরিব মানুষদের চড়া সুদে ঋণ দিয়ে তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। কিন্তু আজ তিনি যে সুদ নিচ্ছেন, সেটা টাকার নয়, রক্তের। প্রতিটা খুন, প্রতিটা অপরাধের দায় কার? যারা পুলিশ মেরেছে, থানা পুড়িয়েছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে পঙ্গু করে দিয়েছে, তাদের দায় নেই?
জেনারেল ওয়াকার একজন সেনা কর্মকর্তা হিসেবে দেশের নিরাপত্তার দায়িত্বে আছেন। কিন্তু তিনি কি সেই দায়িত্ব পালন করছেন? নাকি একটা অবৈধ সরকারকে টিকিয়ে রাখার কাজে ব্যস্ত? সেনাবাহিনী যদি জনগণের নিরাপত্তার জন্য থাকে, তাহলে প্রতিদিন এগারোটা খুন হচ্ছে কেন?
আসল সত্যটা হলো, যারা ক্ষমতায় এসেছেন রক্তের বিনিময়ে, তারা জানেন ক্ষমতায় থাকতে হলেও রক্তের প্রয়োজন হবে। তাই তারা কখনোই চাইবেন না খুন-খারাবি বন্ধ হোক। বরং একটা নিয়ন্ত্রিত বিশৃঙ্খলা তাদের জন্য সুবিধাজনক। মানুষ যখন ভয়ে থাকবে, তখন প্রশ্ন করবে না। যখন প্রতিবাদ করলেই বিপদের আশঙ্কা থাকবে, তখন কেউ মুখ খুলবে না।
বিশেষজ্ঞরা ঠিকই বলেছেন, এখন মানুষ মনে করছে নিজেকে গুটিয়ে রাখলে, অন্যের বিপদ দেখলে এড়িয়ে গেলে, নিরাপদ থাকা যাবে। কিন্তু এটা সবচেয়ে বড় ভুল। একটা সমাজে যখন সবাই সবার জন্য নিরাপদ না, তখন কেউই নিরাপদ না।
আর এই অনিরাপত্তার জন্য দায়ী কারা? যারা সংবিধান লঙ্ঘন করে ক্ষমতায় এসেছে, যারা নিজেরাই আইনের শাসন ভেঙে ফেলেছে, তারাই দায়ী। ইউনূস আর ওয়াকার যতদিন ক্ষমতায় থাকবেন, এই খুনের মিছিল ততদিন লম্বা হবে। এটা কোনো অলীক কল্পনা নয়, এটা বাস্তবতা। যে হাতে রক্ত লেগে আছে, সেই হাত দিয়ে শান্তি আসে না।
