শেরপুরের চরভাবনা গ্রামে শুক্রবার রাতে যা ঘটেছে, তা বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার জন্য এক অশনিসংকেত। একদল ধর্মীয় নেতা ও তাদের অনুসারীরা জোর করে একটি জারি গানের আসর বন্ধ করতে গিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। এরপর যা হলো তা আরও উদ্বেগজনক। শতাধিক মাদ্রাসা বন্ধ রেখে সড়ক অবরোধ করা হলো। একটি গ্রামের মানুষকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হলো। তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, যাতায়াত সবকিছুতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলো।
এই ঘটনাটি বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। গত চার-পাঁচ বছরে শেরপুরের চরাঞ্চলে ইত্তেফাকুল উলামা নামের সংগঠনটি নাকি একের পর এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কোন অধিকারে? সংবিধান কি তাদের এই ক্ষমতা দিয়েছে? আইন কি তাদের হাতে তুলে দিয়েছে?
বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল। এখানে সংস্কৃতি, শিল্প, গানের চর্চা হাজার বছরের ঐতিহ্য। জারি, সারি, ভাটিয়ালি, পালাগান এই জনপদের প্রাণ। কিন্তু গত কয়েক মাসে দেশে যা ঘটেছে, তার পরিণতি এখন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। জুলাইয়ের ঘটনার পর যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল, যে রক্তপাত হয়েছিল, তার সুবিধা নিয়ে মৌলবাদী শক্তিগুলো এখন প্রকাশ্যে তাদের আধিপত্য বিস্তার করছে।
মুহাম্মদ ইউনূস ও সেনাপ্রধান ওয়াকার উজ জামানের নেতৃত্বাধীন বর্তমান ব্যবস্থা এসব ঘটনার ব্যাপারে কার্যত নীরব। একটি নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে যারা ক্ষমতায় এসেছেন, তাদের কাছে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বা সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার প্রত্যাশা করাটাই হয়তো ভুল। জুলাইয়ের সেই রক্তক্ষয়ী দাঙ্গার পর যখন রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হলো, যখন প্রশাসনিক কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়লো, তখন সবচেয়ে বেশি লাভবান হলো চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলো।
শেরপুরের ঘটনায় যা দেখা যাচ্ছে তা আসলে একধরনের সাংস্কৃতিক সন্ত্রাস। দুই-আড়াই শ জনের একটি দল মিছিল নিয়ে গিয়ে একটি বৈধ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ভেঙে দেয়, শামিয়ানা পুড়িয়ে দেয়। এরপর যখন স্থানীয়রা প্রতিরোধ করে, তখন তারা নিজেদের ‘আক্রান্ত’ বলে দাবি করে পুরো এলাকায় অবরোধ আরোপ করে। এটা একধরনের প্রতিশোধমূলক শাস্তি, যা আধুনিক সভ্য সমাজে সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য।
আরও আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই কর্মসূচিতে একজন সরকারি কর্মকর্তা পর্যন্ত একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ময়মনসিংহ বিভাগের পরিচালক এ কে এম আলী উল্লাহ আহসান এই অবরোধে বক্তব্য দিয়েছেন। একজন শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তা, যার দায়িত্ব শিক্ষার্থীদের মধ্যে উদারতা ও সহিষ্ণুতার চর্চা করা, তিনি কীভাবে এমন একটি অগণতান্ত্রিক কর্মসূচিতে সমর্থন দিতে পারেন? এটা কি বর্তমান প্রশাসনের মানসিকতার প্রতিফলন নয়?
স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. জাফরের কথাটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেছেন, “আমি জনপ্রতিনিধি। আমাকে আলেমদের সঙ্গে যেমন থাকতে হয়, চোরের সঙ্গেও কথা বলতে হয়।” এই বক্তব্যে তার অসহায়ত্বটা স্পষ্ট। একজন নির্বাচিত প্রতিনিধি তার নিজের জমিতে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারছেন না। তাকে ব্যাখ্যা দিতে হচ্ছে কেন তিনি এটা করেছেন।
ইউনূস ও ওয়াকারের নেতৃত্বাধীন সরকারের দায়বদ্ধতা এখানে অনস্বীকার্য। তারা যে পদ্ধতিতে ক্ষমতায় এসেছেন, তা সংবিধানসম্মত ছিল না। জুলাইয়ের সেই রক্তাক্ত অধ্যায়ে যে শক্তিগুলো সক্রিয় ছিল, যাদের সহায়তায় রাস্তায় হত্যাকাণ্ড হয়েছিল, তাদের অনেকেই এখন খোলাখুলি তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। শেরপুরের ঘটনা তারই একটি উদাহরণ মাত্র।
থানার ওসি বলেছেন, পরিস্থিতি শান্ত। কেউ লিখিত অভিযোগ করেনি। কিন্তু কেন করবে? যখন একটি গোটা গ্রামকে বয়কটের হুমকি দেওয়া হয়, যখন মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের সমাবেশে হাজার হাজার মানুষ রাস্তা অবরোধ করে, তখন সাধারণ মানুষ কীভাবে থানায় অভিযোগ করবে? তারা জানে, বর্তমান প্রশাসন এসব মোকাবেলা করার মতো শক্তি বা ইচ্ছা কোনোটাই রাখে না।
এই ঘটনার পেছনে আরও বড় একটা প্রশ্ন আছে। বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা কি এখন আর নেই? একদল মানুষ কি ঠিক করে দেবে কোন গান হবে, কোন অনুষ্ঠান হবে? সংবিধান কি এই অধিকার দিয়েছে? ১৯৭২ সালের সংবিধানে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা, বাক্-স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক অধিকারের কথা বলা আছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সেসব শুধুই কাগজে-কলমে।
ইউনূসের সরকার ক্ষমতায় এসেছিল সংস্কারের নামে। কিন্তু কী সংস্কার দেখছি আমরা? একদিকে রাজনৈতিক দলগুলোকে দমন করা হচ্ছে, অন্যদিকে মৌলবাদী শক্তিগুলো প্রকাশ্যে আইন হাতে তুলে নিচ্ছে। সেনাপ্রধান ওয়াকার উজ জামান যিনি এই পুরো ব্যবস্থার একজন প্রধান স্তম্ভ, তিনি কি এসব দেখছেন না? নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে চোখ বন্ধ রেখেছেন?
সত্যি বলতে, জুলাইয়ের পর থেকে যা হচ্ছে তা একটি পরিকল্পিত এজেন্ডারই অংশ। একটি নির্বাচিত সরকারকে সরিয়ে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে পাশ কাটিয়ে যারা ক্ষমতায় এসেছেন, তারা আসলে কোন শক্তির কাছে ঋণী সেটা এখন পরিষ্কার হচ্ছে। চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলো এখন তাদের পাওনা আদায় করছে।
বাংলাদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করেছিল অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক একটি দেশের জন্য। আজ সেই দেশে একটি গান গাওয়ার জন্য, একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করার জন্য মানুষকে জীবনের ঝুঁকি নিতে হচ্ছে। এর দায় কার? এর জবাব কে দেবে? ইতিহাস কিন্তু সব হিসাব রাখে। আজ যারা নীরব দর্শক হয়ে আছেন, তাদের এই নীরবতার মূল্য একদিন দিতে হবে।
