শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
‘এইটাই বোধহয় বেশিরভাগ মেয়ের সত্যিকারের ছবি। এইভাবেই তারা নিজেদের সাজিয়ে রাখে সংসারে, জোড়াতালি দিয়ে। আসলে ছোটবেলা থেকেই তাদের বোঝানো হয় তো, শেখানো হয় যে তারা প্রত্যেকেই পৃথিবীতে এসেছে কেবলমাত্র অন্যদের খুশি করতে। ছোটবেলায় বাবা-মা, তারপর বিয়ের পর স্বামী-শ্বশুর-শাশুড়ি, তারপর ছেলেমেয়ে, তারপরে নাতি-নাতনি। এইভাবেই সকলের ইচ্ছে-অনিচ্ছে, ভাল লাগা-মন্দ লাগার দাম দিতে দিতে … একসময় তারা নিজেরাই শেষ হয়ে যায়।’
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মন্ত্র যেন নয়ের দশকের শুরুতে বলা হয়েছিল ‘শ্বেত পাথরের থালা’র বন্দনার মুখ দিয়ে। তবে তার বহু আগে থেকেই মধ্যবিত্ত বাঙালি নারীর অবস্থানকে আমূল বদলে দিয়েছিল পর্দায় ও বাস্তবে যাঁর উপস্থিতি তিনি অপর্ণা সেন Aparna Sen ।
১৯৪৫। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেহ রাখলেন, গান্ধীজির ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন পেরিয়ে ভারতবর্ষ স্বাধীনতার শেষ ধাপে প্রবেশ করল, এমন সন্ধিক্ষণে চিদানন্দ দাশগুপ্ত-সুপ্রিয়া দাশগুপ্তর কোল আলো করে এল মেয়ে ‘রিনা’। তাঁরা তিন বোন। অপর্ণা, অনুরাধা ও সোহিনী। রিনার ভেতর যদি প্রথম কেউ নারীমুক্তি জাগিয়ে তুলে থাকেন তবে তিনি ছিলেন তাঁর দিদিমা। দিদিমা ছিলেন ব্রাহ্ম বাড়ির মেয়ে, ঢাকার ইডেন স্কুলে পড়েছেন, পড়িয়েছেন। পড়িয়ে যে সাতশো টাকা জমিয়েছিলেন তা তাঁর স্বামীকে দেন মূলধন হিসেবে। সেই টাকায় অপর্ণার দাদু ‘জলযোগ’ মিষ্টির দোকান শুরু করেন। জলযোগের দই খেয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটা কবিতাও লিখে দিয়েছিলেন। অপর্ণার মা সুপ্রিয়া দাশগুপ্ত ভাল সেতার বাজাতে পারতেন। মিষ্টি গানের গলা ও নাচতে পারতেন। উদয় শঙ্করের আলমোড়া থেকে নাচের দলে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব এসেছিল। অন্যদিকে অপর্ণার বাবা চিন্তাবিদ বাংলা নব্য চলচ্চিত্রের পরিচালক চিদানন্দ দাশগুপ্ত। সেই সূত্রেই সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে পরিচয়। চলচ্চিত্রে নায়িকার তালিকায় উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় এক নব সংযোজন, ‘তিন কন্যা’র শেষ কন্যা মৃন্ময়ী ছিলেন প্রতিশ্রুতিময় ভবিষ্যতের অবশ্যম্ভাবী উত্তরাধিকারী। এমনকি সুদূর ইউরোপ থেকেও পাশ্চাত্য পরিচালক রোমানফ অপর্ণার ‘সমাপ্তি’ দেখে তাঁর ইংরেজি ছবি ‘মার্কোপোলো’-তে অভিনয় করার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। রোমানফই কথা দেন, এ ছবি করতে অপর্ণার পড়াশোনার ক্ষতি হবে না। তিনি ইউরোপে অপর্ণার পড়াশোনার ব্যয়ভার বহন করবেন। কিন্তু শেষ অবধি বাবা চিদানন্দ দাশগুপ্ত সম্মতি দেননি। হায়ার সেকেন্ডারি শেষ হবার পর সত্যজিৎ সহকারী নিত্যানন্দ দত্তর প্রথম ছবি ‘বাক্সবদল’ এ অভিনয় করার সম্মতি দেন। বুদ্ধিমতী অপর্ণা বেশ বুঝছিলেন তাঁকে ‘স্টার’ হতে গেলে বানিজ্যিক ছবির নায়িকা হতে হবে। কারণ ছোট থেকেই নায়িকা হওয়ার ইচ্ছে তাঁর ভিতর ছিল। নিজেকে ক্রমশ মৃন্ময়ী থেকে চিন্ময়ী রূপ দিলেন নিজেই। উত্তমকুমারের পাশে এলেন এক এমন নায়িকা, যে ঘাড় বেঁকিয়ে তাকায় না, নায়কের চোখে চোখ রেখে কথা বলে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পাশেও সে সমান সাবলীল। সুচিত্রা সেনের পর বাংলার একমাত্র তারকা নায়িকা হয়ে উঠলেন অপর্ণা সেন। মিসেস সেন তিনি নন, তিনি মিস ক্যালকাটা। পুরুষের পরিচয়ের বাইরে সে নিজেই ‘অনন্যা’।
ছয়, সাত থেকে আটের দশক জুড়ে অপর্ণার নায়িকা রাজত্ব। তবে ইন্ডাস্ট্রি বারবার অপর্ণাকে নষ্ট মেয়ের চরিত্রেও নিয়ে এসেছে। সত্যজিৎ রায়ের ‘পিকু’ থেকে দিলীপ রায়ের ‘নীলকণ্ঠ’ বা বীরেশ চট্টোপাধ্যায়ের ‘মোহনার দিকে’ বা ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’। লক্ষ্মীর সেই সংলাপ মনে পড়ে ‘আমায় রাস্তায় টেনে নামিও না সুধাংশু, আমি যে ঘর বড় ভালবাসি’! ঐ বুকভরা হাহাকার আর যৌনলাস্যে ঝড় তুলতে অপর্ণা ছাড়া কে পারতেন? কিন্তু যৌনতাকে শুধুমাত্র অপর্ণা বিপণন করেননি জিনাত আমন বা পারভিন ববির মতো।থিয়েটারেও ‘ভাল খারাপ মেয়ে’ থেকে ‘পান্নাবাঈ’ রূপে অপর্ণা আইকন। বাংলা ছবির আজও অপরিহার্য তারকা অপর্ণা সেন।
১৯৮১ তে অপর্ণার প্রথম ইংরেজি ছবি ‘থার্টিসিক্স চৌরঙ্গী লেন’, যে ছবি চমকে দিয়েছিল সত্যজিৎ-মৃণাল থেকে বিশ্বচলচ্চিত্রপ্রেমীদের। নারীর একাকীত্ব বারবার উঠে এসছে তাঁর ছবিতে। এরপর ১৯৮৫ তে ‘পরমা’। অসম বয়সের পরকীয়ার শেষে পরমা রাখী গুলজার যখন বলেন ‘আমার তো কোনও অপরাধবোধ নেই’! যা নাড়িয়ে দেয় সমাজকে। অপর্ণার দুটি ছবি বিশেষ ভাবে বানিজ্যসফল ছবি ‘পরমা’ আর ‘পারমিতার একদিন’। শহর থেকে শহরতলির প্রতিটি সিঙ্গেলস্ক্রিন তিন শোয়ে হাউজফুল। ২০০০ সালে ‘কাহো না প্যায়ার হ্যায়’ র পাশাপাশি ‘পারমিতার একদিন’ বিশাল রেকর্ড হিট। যা আজকের টালিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রির কাছে স্বপ্ন।
আমাদের কৈশোর জুড়ে অপর্ণা সেন এক মোহিনীমায়া। আনন্দলোকের গোপন গল্প থেকে রাস্তার দেওয়ালে অপর্ণা সেনের ছবির কাগজের পোস্টার যেন এক স্বপ্নমায়া আজও। ‘উনিশে এপ্রিল’ থেকে ‘তিতলি’ অপর্ণা সেনের ছবি আঁকা সেসব পোস্টার কী মুগ্ধনয়নে দেখতাম। পাশাপাশি ওঁর ‘সতী’,’যুগান্ত’, মিঃ অ্যান্ড মিসেস আইয়ার’ থেকে ‘ফিফটিন পার্ক অ্যাভিনিউ’ তো আছেই।
অনেকেই বলেন অভিনেত্রী অপর্ণার থেকে পরিচালক অপর্ণা অনেক এগিয়ে। কিন্তু আর কী কেউ পারতেন লক্ষ্মী, সুচেতা, বন্দনা, সুদীপা, ইন্দিরা, জয়ন্তী হতে? আজ অপর্ণার আশি। আজ এইসব চরিত্রদেরও উদযাপন দিন। অভিনেত্রী অপর্ণা আজও হিটমেশিন বক্সঅফিসে। এখানেই তাঁর অভিনেত্রী সত্তার সাফল্য। ১৯৮৫ তে আবারও এক চমক ‘সানন্দা’ তে সম্পাদকের ভূমিকায়। সানন্দা খুলতেই অপর্ণার লেখা সম্পাদকীয় আর সেই নাকে চশমা ঝোলানো ছবি আজও কেউ কী ভুলতে পারবে? অপর্ণা একমাত্র নায়িকা যিনি নারী থেকে কুইয়ার সম্প্রদায়ের রোলমডেল। আজ তিনি ৮০ তে। কিন্তু বলছেন না ‘আশিতে আসিও না’। আজও তিনি চিরযৌবনা। আমার সামনেই রিনাদি ফোনে এক বন্ধুকে বললেন ‘না রে তোরা বলিস আমার বয়স বাড়ে না! কিন্তু বাড়ে!’ জরাকেও তিনি লক্ষণরেখার বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখার ক্ষমতা রাখেন।
আমার জীবনের স্বপ্নপূরণ ঈশ্বরী অপর্ণা সেনের ভালবাসা পাওয়া। তাঁর কাছে বসে শিখতে পারা, শুনতে পারা ও তাঁর সঙ্গে বসে গল্প করা। উনি সবটা নিয়ে সুন্দর। ওঁর বাড়িতে যখন খাবার পরিবেশন করেন সেটাও কত সুন্দর সুচারু। অতিথির মনে রয়ে যাবে এই আপ্যায়ণ। শুধু তাই নয়, যার ছবি দেখতে পড়াশোনা তাড়াতাড়ি করে টিভির সামনে বসতাম তিনিই আমার সঙ্গে বসে খাচ্ছেন যা স্বর্গীয় অনুভূতি। যাঁকে তিনি ভালবাসেন সেই মর্যাদা দিয়েই ভালবাসেন। তিনি শুধু কমলিনী-কঙ্কনার মা নন। সর্বসময় তিনি তাঁর দুই পোষ্যর মা। তারাও খুব আদুরে। এই ছবিতে আশেপাশেই আছে তারা।
অপর্ণা সেন যখন আমার লেখা পড়ে বলেন ‘তুমি আমার কাছে একটা ছোট্ট ছেলে তোমায় একটু শেখাব না!’ এ যে কত বড় প্রাপ্তি। আজও তিনি স্থিরযৌবনা। আজও সুদর্শনাসু-কে কুর্নিশ জানিয়ে বলতে হয়
‘নাগরিক ক্লান্তিতে তোমাকে চাই
এক ফোঁটা শান্তিতে তোমাকে চাই
বহুদূর হেঁটে এসে তোমাকে চাই
এ জীবন ভালোবেসে তোমাকে চাই…’
