কবির য়াহমদ
সুপ্রিম কোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছিলেন, তারাই আবার এর পুনর্বহাল করলেন। মাঝখানে সুরমায় অনেক জল গড়িয়েছে, বুড়িগঙ্গার জল আরও কালো হয়েছে, প্রমত্তা পদ্মার বুকে সমৃদ্ধির সোপান হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে স্বপ্নের পদ্মাসেতু।
তবে আদালত দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে এনেও লাভ নাই। বিএনপি ক্ষমতায় যাওয়ার পর আগের মতো এই ব্যবস্থাকে শেষ করে দেবে। ক্ষমতায় থাকাকালে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ‘পাগল আর শিশু ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ নয়’। তবু তার সরকারকে আন্দোলনের মুখে বাধ্য হয়ে তেরোদিনের সংসদে মধ্যরাতে পাশ করতে হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
বাংলাদেশে একবারই নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়েছিল। সেটা করেছিল আওয়ামী লীগ ২০০১ সালে। বস্তুত এই চুয়ান্ন বছরের বাংলাদেশে ওই একবারই শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়েছিল [বঙ্গবন্ধু ও জিয়া হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়ে ক্ষমতাচ্যুত; এরশাদ আন্দোলনের মুখে ক্ষমতাচ্যুত; খালেদা জিয়া দুইবার আন্দোলনের মুখে ক্ষমত্যাচুত; শেখ হাসিনা একবার শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা হস্তান্তর ও আরেকবার আন্দোলনের মুখে ক্ষমত্যাচ্যুত]। এরপর নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় গিয়ে বিএনপি-জামায়াত যা করেছিল, সেটা বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে কলঙ্কের পথ দেখিয়ে দিয়েছিল।
কেএম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান করতে বিএনপি বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা বাড়ানোর যে খেলা খেলেছিল, সেখান থেকেই ক্রমে বাংলাদেশ পড়ে অন্ধকারের অতল গহ্বরে। ১/১১ বিএনপির সৃষ্ট। বিএনপির মনোনীত রাষ্ট্রপতি ইয়াজ উদ্দিন মতান্তরে ‘ইয়েস উদ্দিন’-এর কারণে বাংলাদেশে নেমে আসে ভয়াল এক-এগারো।
এক-এগারোর সরকারের পর আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকাকালে আদালত থেকে বাতিল হয়ে গিয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়ার পর আদালতের একটা রায়ে ফিরিয়ে আনা হয়েছে এই ব্যবস্থা। কিন্তু যেভাবে ফিরল, সেটা ফেরা নয়; বরং এটা আরও অনিশ্চয়তা।
আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সংবিধানে ফেরালেন, কিন্তু একটা অসাংবিধানিক সরকারের হাতে দিয়ে রাখলেন ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের দায়িত্ব। এটা কীধরনের সংবিধান প্রতিপালন—এ বোধের অতীত।
কেউ ক্ষমতা ছাড়তে রাজি নয়। ইউনুসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন কেন দেওয়া হলো সেটা বুঝতে কারো বাকি থাকে না। পনেরো মাসের নির্মাণপ্রক্রিয়া অন্য কারো হাতে দিতে রাজি না নিশ্চয়।
ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ফেরার রায়ের কোন কার্যকারিতা থাকবে না।
বিএনপি কখনই স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছাড়েনি। প্রতিবারই তাদেরকে আন্দোলনের মুখে বিদায় নিতে হয়েছে। তারা আগামীতে স্বেচ্ছায় ক্ষমতা হস্তান্তর করবে—এটা বিশ্বাস হয় না। এতখানি গণতান্ত্রিক দল বিএনপি হতে পারেনি।
পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি হোক, তবু কাউকে মিছামিছি ‘ফারিশতা’ বানানোর দরকার নাই। রাজনৈতিক বাস্তবতার সিঁড়ি ধরে আগামীর বাংলাদেশকে বিশ্লেষণ ও বুঝতে চেষ্টা করুন।
