ইউনূস সরকারের আমলে স্বাস্থ্য খাতে চলমান ১৩ হাজার কোটি টাকার একটি উন্নয়ন প্রকল্পে অস্বাভাবিক ব্যয়ের অভিযোগ উঠেছে, যা এখন সরাসরি সরকারের বিরুদ্ধে সাগরচুরির অভিযোগের রূপ নিয়েছে।
উক্ত প্রকল্পে সাধারণ কম্পিউটারের দাম ৭ লাখ টাকা নির্ধারণ এবং পরামর্শদানের জন্য ২১৬ কোটি টাকা বরাদ্দ—এই অসঙ্গতিগুলো নিয়ে সরব সাধারণ মানুষ।
জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) দ্বারা অনুমোদিত এই প্রকল্পটি স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নের নামে চললেও, হোয়াইট পেপার প্রতিবেদনে স্বাস্থ্য খাতে ‘সিস্টেম্যাটিক দুর্নীতি’র উল্লেখ রয়েছে, যা ইউনূস সরকারের স্বচ্ছতা প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক সভায় উল্লেখিত এই প্রকল্পটি স্বাস্থ্য অবকাঠামো মজবুত করা, ডিজিটাল স্বাস্থ্য সিস্টেম চালু এবং চিকিৎসা সরঞ্জাম সংগ্রহের উপর কেন্দ্রীভূত। মোট ব্যয় ১৩,০০০ কোটি টাকার মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে ৮,৫০০ কোটি, বিদেশি ঋণ থেকে ৩,২০০ কোটি এবং সংস্থার নিজস্ব অর্থায়ন থেকে ১,৩০০ করোরি বরাদ্দ নির্ধারিত।
কিন্তু প্রকল্পের বিস্তারিত বাজেট বিশ্লেষণে দেখা গেছে, আইটি সেক্টরে কেনাকাটায় অস্বাভাবিক মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, একটি সাধারণ মানের ডেস্কটপ কম্পিউটারের (ইন্টেল কোর আই৫ প্রসেসর, ৮ জিবি র্যাম, ৫১২ জিবি এসএসডি) বাজার মূল্য ৫০-৬০ হাজার টাকার মধ্যে থাকলেও, প্রকল্পে এর দাম ৭ লাখ টাকা ধরা হয়েছে। কেনা হচ্ছে ৮০৫.৫০ কোটি টাকায় এমন ১১,৮৭০টি কম্পিউটার। কর্মকর্তাদের ভ্রমণ বিলাসে ব্যয় ধরা হয়েছে ১২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ।
একইভাবে, পরামর্শদান এবং কনসালটেন্সি ফি-এর জন্য ২১৬ কোটি টাকা বরাদ্দ, যা প্রকল্পের মোট ব্যয়ের প্রায় ১.৬ শতাংশ।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করতে চাইলে বলেন, “এই প্রকল্পটি বিগত সরকারের আমলে প্রস্তাবিত হলেও অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে এর ব্যয় পুনর্বিবেচনা না করে অনুমোদন করা হয়েছে। কম্পিউটারের মতো সাধারণ যন্ত্রপাতির দাম এত উচ্চতর হওয়া অস্বাভাবিক এবং সম্ভবত টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অনিয়ম বা ওভারপ্রাইসিংয়ের ফল।”
পরিকল্পনা কমিশনের সূত্র জানায়, একনেকের সাম্প্রতিক সভায় (১লা ডিসেম্বর) ১৬ হাজার ৩২ কোটি টাকার ১৮টি প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছে, যার মধ্যে স্বাস্থ্য খাতের এই প্রকল্পটি অন্তর্ভুক্ত। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সভাপতিত্বাধীন সভায় প্রকল্পটির ব্যয় নির্বিঘ্নে অনুমোদিত হলেও, বিস্তারিত অডিটের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
তবে, হোয়াই পেপার রিপোর্টে (ডিসেম্বর ১) বলা হয়েছে, স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তর (ডিজিএইচএস)-এর অধীনে প্রাপ্তি ব্যবস্থায় ‘ওপেন টেন্ডার’ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি ব্যাপক, যা অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে অব্যাহত।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং অর্থনীতিবিদরা এই ব্যয়কে ‘সাগরচুরির প্রমাণ’ বলে অভিহিত করছেন।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) এক সদস্য বলেন, “স্বাস্থ্য খাতে টাকা বরাদ্দ হচ্ছে, কিন্তু এটি কীভাবে খরচ হচ্ছে তা পর্যবেক্ষণ করা দরকার। ২১৬ কোটি পরামর্শে খরচ করে আমরা কতটা স্বাস্থ্যসেবা পাব? এর পরিবর্তে ডাক্তার-নার্স নিয়োগ বা ওষুধ সংগ্রহে এই অর্থ ব্যবহার করলে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা অনেক উন্নত হতো।”
অর্থনীতিবিদ ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদের মতে, স্বাস্থ্য খাতে অর্থায়নের অভাব নেই, কিন্তু দুর্নীতি ও অদক্ষতা এর প্রধান বাধা।
তিনি বলেন, “বাজেটে স্বাস্থ্যের জন্য ৫ শতাংশেরও কম বরাদ্দ, কিন্তু প্রকল্পভিত্তিক ব্যয়ে এমন অস্বাভাবিকতা দেখলে জনগণের আস্থা ক্ষয় হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে এখন সাগরচুরির অভিযোগ উঠছে, যা সংস্কারের প্রতিশ্রুতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।”
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, প্রকল্পের ব্যয় পুনর্বিবেচনা করা হবে এবং অভিযোগগুলো তদন্ত করা হচ্ছে। জনমত গঠনে সোশ্যাল মিডিয়ায়ও এই ঘটনা ছড়িয়ে পড়েছে, যেখানে নেটিজেনরা বলছেন, “স্বাস্থ্যের নামে লুটতরাজ বন্ধ করুন! অন্তর্বর্তী সরকারও কি একই পথে?”
