হামলার নিন্দা জানিয়ে ১৮৩ নাগরিকের বিবৃতি
পাঠ্যবইয়ের পেছনের প্রচ্ছদ থেকে ‘আদিবাসী’ শব্দযুক্ত গ্রাফিতি সরিয়ে ফেলা, বিক্ষোভকারী আদিবাসীদের ওপর ন্যক্কারজনক আক্রমণ, সংক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ মিছিলে পুলিশি হামলার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন দেশ-বিদেশে বসবাসকারী ১৮৩ জন বাংলাদেশি নাগরিক। তাঁরা পাঠ্যপুস্তক ও সংবিধানে আদিবাসীদের স্বীকৃতির দাবি জানিয়েছেন।
নেটওয়ার্ক ফর ডেমোক্রেটিক বাংলাদেশ নামের আন্তর্জাতিক অ্যাকটিভিস্ট সংগঠনের ব্যানারে আজ রোববার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এই নিন্দা, প্রতিবাদ ও দাবি জানানো হয়। নেটওয়ার্কের পক্ষে বিবৃতিটি পাঠিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানের গ্র্যান্ড ভ্যালি স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আজফার হোসেন।
বিবৃতিতে বলা হয়, আওয়ামী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে পাহাড় ও সমতলের আদিবাসীদের অংশগ্রহণ ছিল। ফ্যাসিবাদী শাসকের পতন ঘটেছে। কিন্তু ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার এখনো অবসান ঘটেনি। গণ-অভ্যুত্থানের পর আদিবাসীরা মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। আদিবাসীদের বাড়িঘর, দোকানপাট, বৌদ্ধবিহারে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, সম্প্রতি ঢাকায় স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি নামে একটি ভুঁইফোড় উগ্র জাতিবাদী সংগঠনের আবির্ভাব দেখা যায়। তারা পাঠ্যপুস্তকের পেছনের প্রচ্ছদ থেকে ‘আদিবাসী’ শব্দসংবলিত গ্রাফিতি সরিয়ে ফেলার দাবি জানায়। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) গ্রাফিতিটি সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। একই সঙ্গে এনসিটিবি চেয়ারম্যান গণমাধ্যমে জানান, ‘বইয়ের কোথাও আদিবাসী শব্দ নেই।’ বাস্তবিকই ২০২৫ শিক্ষাবছরের পাঠ্যপুস্তকের কোথাও ‘আদিবাসী’ শব্দ নেই। সেখানে রয়েছে ‘নৃগোষ্ঠী’, ‘ভিন্ন নৃ-গোষ্ঠী’, ‘বিভিন্ন নৃগোষ্ঠী’ কিংবা ‘অন্যান্য নৃগোষ্ঠী’। যা আগের শিক্ষাবছরে ছিল ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’।
বিবৃতিতে বলা হয়, পাঠ্যপুস্তকে ভয়ানকভাবে আদিবাসীদের অপরায়ণ ও বিমানবিকীকরণ করা হয়েছে। পাঠ্যপুস্তকের এই অপরায়ণ, বৈষম্যের মূলে রয়েছে ১৯৭২ সালে প্রণীত ও ১৭ বার সংশোধিত জাতিবাদী সংবিধান। যেখানে আদিবাসীদের জাতিসত্তার কোনো স্বীকৃতি নেই। যেখানে আদিবাসীদের পরিচিত করা হয়েছে ‘উপজাতি’, ‘ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী, সম্প্রদায়’ হিসেবে। স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি ফ্যাসিবাদী এই সংবিধানকেই ঢাল বানিয়েছে। শুধু তা–ই নয়, ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের স্লোগান ‘তুমি কে, আমি কে, বাঙালি বাঙালি’ বলেই তারা আদিবাসীদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ছিল যে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বহুত্ববাদী সমাজগঠন, তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েই চালানো হচ্ছে এই আক্রমণ। রাষ্ট্রশক্তিও এই আক্রমণে শরিক। এর প্রমাণ মেলে ১৫ জানুয়ারি আদিবাসীদের ওপর হামলার সময় পুলিশের নির্লিপ্ত দর্শকের ভূমিকা; এর প্রতিবাদে ১৬ জানুয়ারি সংক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ মিছিলে পুলিশের বেধড়ক লাঠিপেটা, জলকামান, কাঁদানে গ্যাসের শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড হামলার মধ্য দিয়ে।
বিবৃতিদাতারা বলেন, তাঁরা স্পষ্টভাবে বলতে চান, ‘উপজাতি’ বা ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’র মতো অবমাননাকর শব্দ সংবিধান ও পাঠ্যপুস্তক থেকে সরানোই যথেষ্ট নয়। ‘আদিবাসী’ শব্দটি কেবল ‘ভিন্ন’ বা ‘অন্যান্য’ নৃগোষ্ঠী দিয়ে প্রতিস্থাপনযোগ্য শব্দ নয়। আদিবাসী (indigenous) শব্দের অর্থ, কোনো জাতি কত আগে থেকে একটা দেশে বাস করছে, তা নয়; বরং কোনো একটি ভৌগোলিক অঞ্চলে যাঁরা প্রাক্-ঔপনিবেশিক আমল থেকে যুগ যুগ ধরে কেবল বাসই করছেন না, সে অঞ্চলের প্রকৃতির সঙ্গে শক্তিশালী বন্ধনে আবদ্ধ, যাঁদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রয়েছে, যাঁদের স্বতন্ত্র অর্থনৈতিক, সামাজিক, এমনকি রাজনৈতিক ব্যবস্থা টিকে আছে, যাঁরা নিজেদের এই স্বাতন্ত্র্য টিকিয়ে রাখতে চান, সংখ্যাগরিষ্ঠ আধিপত্যকারী জাতিগোষ্ঠী থেকে ভিন্ন যেকোনো জনগোষ্ঠী যাঁরা নিজেদের আদিবাসী হিসেবে পরিচিত করতে চান, তাঁরাই আদিবাসী। আদিবাসীর এই সংজ্ঞানুসারে বাংলাদেশের আধিপত্যকারী বা প্রধান (dominant) বাঙালি জাতিকে আদিবাসী বলার কোনো উপায় বা কারণ নেই। আদিবাসী জাতিগুলোকে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিলে পার্বত্যাঞ্চল বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কোনো আশঙ্কাও নেই। কেননা, বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমার মধ্যেই আদিবাসীরা নিজস্ব ভূমি, তথা তাঁদের নিজস্ব জীবন, সম্পদ ও সংস্কৃতি রক্ষার অধিকার চাইছেন। এটি তাঁদের অস্তিত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত। ফলে আদিবাসীদের স্বীকৃতির বিরুদ্ধে, তাঁদের অধিকারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো আধিপত্যবাদী ও জাতিবাদী রাজনীতি বাংলাদেশের জন্য আত্মবিধ্বংসী, যা দেশের বহু বর্ণিল ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে অস্বীকার করার মাধ্যমে শক্তিলাভ করে। সাম্প্রতিক জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ছবি, গ্রাফিতি, প্রতিবাদী ভাষ্য ইত্যাদি থেকে আদিবাসী শব্দটি মুছে দেওয়া সেই রাজনীতির অংশমাত্র। এই রাজনীতিই বস্তুত ফ্যাসিবাদ তৈরি করে। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে ফ্যাসিবাদকে জিইয়ে রাখে। এই জাতিবাদী-ফ্যাসিবাদী রাজনীতির কবর রচনা করেই কেবল জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার অন্তর্ভুক্তি ও অংশগ্রহণমূলক একটি বহুত্ববাদী সমাজ গঠন করা সম্ভব।
পাঠ্যপুস্তক থেকে আদিবাসী শব্দসংবলিত গ্রাফিতি বাদ দেওয়ার প্রতিবাদে এনসিটিবির সামনে আদিবাসীদের সমাবেশের ওপরে ন্যক্কারজনক হামলার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার ও বিচারের ব্যবস্থা করা। সংক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার মিছিলে হামলাকারী পুলিশসহ নির্দেশদাতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
পাঠ্যপুস্তক থেকে আদিবাসী শব্দসংবলিত গ্রাফিতি সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা। এনসিটিবির চেয়ারম্যানকে প্রকাশ্যে ক্ষমা প্রার্থনা করা। পাঠ্যপুস্তক থেকে আদিবাসীদের অপরায়ণ ও বিমানবিকীকরণের যাবতীয় প্রকাশভঙ্গি দূর করা। আদিবাসীদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা। আদিবাসীদের মাতৃভাষায় শিক্ষার ব্যবস্থা করা।
আদিবাসীদের যথাযথ সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান। সংবিধানে নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশি পরিচয় থাকলেই চলবে না, জাতি হিসেবে বাংলাদেশের সব জাতিসত্তার স্বীকৃতি নিশ্চিত করা। সংবিধানে ‘উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়’-এর বদলে আদিবাসী পরিচয় প্রদান করা। সব ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, শিল্পকলার পরিপোষণ, উন্নয়নের পাশাপাশি আদিবাসীদের সংস্কৃতি-ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও বিকাশের অঙ্গীকার–সংবলিত বিধান রাখা।
জাতিসংঘের ‘ডিক্লারেশন অন দ্য রাইটস অব ইন্ডিজেনাস পিপলস’ (২০০৭) সনদে পরিপূর্ণভাবে অনুস্বাক্ষর করা। আদিবাসীদের ভূমির অধিকার নিশ্চিত করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। পার্বত্যাঞ্চল থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করা।
বিবৃতিতে সই করা ব্যক্তিদের মধ্যে আছেন আনু মুহাম্মদ (সম্পাদক, সর্বজনকথা), আজফার হোসেন (শিক্ষক, গ্র্যান্ড ভ্যালি স্টেট ইউনিভার্সিটি), কামরুল হাসান মামুন, (শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়), ফাহমিদুল হক (লেখক ও গবেষক), মোশাহিদা সুলতানা (শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়), পাভেল পার্থ (লেখক ও গবেষক), রাহাত মুস্তাফিজ (লেখক ও অ্যাকটিভিস্ট), মনিরা রহমান (মানসিক স্বাস্থ্য আন্দোলনকর্মী), নাসরিন সিরাজ (নৃবিজ্ঞানী), স্নেহাদ্রি চক্রবর্ত্তী (আইনজীবী), তনুশ্রী পাল (চাকরিজীবী), জয়দীপ ভট্টাচার্য (চিকিৎসক), মালবিকা দিপান্বিতা রায় (স্থপতি ও উদ্যোক্তা), ফেরদৌস আরা রুমী (কবি ও অধিকারকর্মী), মীর হুযাইফা আল মামদূহ (গবেষক), পুন্নি কবীর (গবেষক), ইশরাত জাহান ঊর্মি (সাংবাদিক), উ. মং সিং (গবেষক), নাহিদ আখতার ইমু (ভয়েস ডিরেক্টর, দীপ্ত টিভি), লিপি চাকমা (শিক্ষার্থী) প্রমুখ।