কবির য়াহমদ
জবরদস্তি করে আওয়ামী লীগকে রাজনীতি করতে না দেওয়া, নির্বাচনের অংশগ্রহণ করতে না দেওয়ার হুমকি, ছাত্রলীগ করা শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন ধ্বংস করে দেওয়া, সনদপত্র বাতিল, আওয়ামী লীগ সমর্থক অজুহাত/অভিযোগ চাকরি থেকে অব্যাহতি, ব্যবসাবাণিজ্য করতে না দেওয়া, স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে না দেওয়াসহ বিবিধ অন্যায় হিতে বিপরীত হতে পারে।
এসবের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের দলের প্রতি নিবেদন বাড়ানো হচ্ছে। ঐক্য হচ্ছে তাদের ইস্পাত-দৃঢ়। দলটির নেতাকর্মীর প্রতি অন্যায় আচরণ অন্যদের সমব্যথী করছেও।
এমন না যে আওয়ামী লীগের সকল স্তরের নেতারা লুটপাট করছিল, এমন না দলটির সকল শ্রেণির সকলে অন্যায্য সুবিধা ভোগ করছিল; এমন না যে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ ছাড়া কেউ চাকরি-ব্যবসাবাণিজ্য ও লেখাপড়ার সুযোগ পেত না। সবই ছিল স্বাভাবিক। সবাই সবকিছু করেছে; কেউ বেশি, কেউ কম।
আওয়ামী লীগের আমলে বিবিধ সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সবাই লেখালেখি করেছে, টেলিভিশন-টেলিভিশনে টক-শো করে, সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলেছে। ইউনূস-সরকারের এই যে উপদেষ্টা, সংস্কার কমিশনের প্রধান ও সদস্যরা, তাদের কেউ জুলাই মাসে পৃথিবীতে নাজিল হয়ে পরে দায়িত্ব গ্রহণ করেনি। তারা আওয়ামী লীগের আমলে নানা মাধ্যমে উপস্থিত হয়ে নিজেদের আওয়ামী-বিরোধী চরিত্রের প্রমাণ রেখেছে বলে আজ ক্ষমতাধর।
আওয়ামী লীগ সরকারকে যত যাই বলুন না কেন, এই শ্রেণির লোকদের বিকাশে দলটির অবদানকে অস্বীকার করতে পারবেন না। আগেও এরা ভিন্ন রূপে ছিল সুবিধাভোগী, এখনো তাই, এবং ভবিষ্যতে যে চেহারা বদলাবে না সে নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না।
কিন্তু এখন, আওয়ামী লীগ নাম শুনলেই লোকজন তেড়ে আসে। নানা অভিধায় উদ্ধৃত করে। জবরদস্তি করে নাগরিক অধিকার কেড়ে নিতে মরিয়া। সরকার রয়েছে এর প্রত্যক্ষ প্ররোচনায়।
এতে কী হচ্ছে? আওয়ামী লীগের করপোরেট কালচারভিত্তিক যে রাজনীতি, ত্যাগী ও তৃণমূলকে অগ্রাহ্য করার যে প্রবণতায় বেশিরভাগ আওয়ামী লীগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিল, তারা ফের সমবেদনা অনুভব করছে দলটির প্রতি। দলটির যে নেতাকর্মীরা ২০০৮-এর নির্বাচনের পর আর নৌকায় ভোট দেয়নি, তারাও এখন দলের দুর্দিনে মমতা অনুভব করছে। দলটির সক্রিয় লোকজনের তুলনায় এই সংখ্যা অন্তত তিনগুণ বেশি।
কীভাবে বলছি তিনগুণ? চোখ ফেরান আওয়ামী লীগের আমলের নির্বাচনের দিকে। আওয়ামী লীগের সমর্থকদের বেশিরভাগই ভোট দিতে যেত না। যদিও চল্লিশের বেশি ভোট প্রদানের চিত্র দেখানো হতো, তবে সংখ্যায় ওসব হয়ত ১২/১৪ ভাগ। ভোট দিতে যারা যেত না, তাদের সবাই নিশ্চয় আওয়ামী লীগ-বিরোধী নয়, তবু যেত না; কারণ গিয়ে কী লাভ, ফলাফল তো অজানা নয়–এই ধারণা ছিল সবার।
জুলাই-আগস্টের ক্ষমতার পরিবর্তন সত্ত্বেও দেশে জনমর্থনগত দিক থেকে কোন পরিবর্তন আসেনি। আওয়ামী লীগ প্রান্ত থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত নেতা হারিয়েছে, কিন্তু কর্মী-সমর্থক হারায়নি। আপনি আওয়ামী লীগের কোন সমর্থককে অভয় দিয়ে তার কথা জানতে চান; দেখবেন–গালাগাল করবে ঠিক, কিন্তু দিনশেষে তালগাছ ছাড়বে না। অর্থাৎ অপেক্ষা করছে দলের ফিরে আসার, নৌকায় ভোট দেওয়ার। এটা চাইলেও বদলাতে পারবেন না। এখন পারবেনই না যখন তার দল অস্তিত্ব সংকটে।
এই যে অবস্থা, এর দায় আছে ইউনূস-সরকার ও তার অতি-উৎসাহী অপরিপক্ব কতিপয় উপদেষ্টার। তাদের স্বেচ্ছাচার, হুমকিধামকি, পেশিবাদী মানসিকতা আওয়ামী লীগের সুপ্ত সমর্থকের মনে ধর্মানুভূতির মতো প্রখর দলানুভূতিকে জাগরূক করেছে। অথচ ক্ষমতাহারা হওয়ার পর এরা যদি স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারত, তবে ক্রমে আওয়ামী লীগ শক্তিহীন হয়ে পড়ত।
এখন যা হচ্ছে তাতে নেতা নাই, তবু কোটি-কোটি সমর্থক আছে দেশে। আগে ছিল বেশিরভাগ সুপ্ত, এখন আছে সুযোগের অপেক্ষায়।
আওয়ামী লীগের ভুল ছিল কর্মীদের অবমূল্যায়ন। ২০১৩-১৪ সালের সরকারবিরোধী আন্দোলন তাদেরকে করেছিল প্রশাসননির্ভর। এরা সরকারকে টিকিয়ে রেখেছিল দশ বছর। এরাসহ বিভিন্ন বাহিনীর সমর্থন হারানোয় আওয়ামী লীগ সরকারকে বিদায় নিতে হয়েছে। অথচ দলটিকে ক্ষমতায় নিয়েছিল সাধারণ কর্মীসমর্থকেরাই।
আওয়ামী লীগের সাথে এখন নেই প্রশাসন ও বিভিন্ন বাহিনী। এখন দলকে ফিরতে হবে তাদের কাছে যারা বাঁচিয়ে রেখেছিল তাদের। মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ আগে থেকেই আওয়ামী-অনুভূতির। এদের অনুভূতি পোক্ত হচ্ছে ক্রমশ, সঙ্গে যুক্ত হতে যাচ্ছে সমব্যথীরা।
আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করতে চায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, নাগরিক কমিটি, ইউনূস-সরকার ও এর সমর্থকেরা। প্রক্রিয়া তাদের জবরদস্তিমূলক। তবে এই প্রক্রিয়া কাজে দেবে বলে হয় না। কারণ ঐতিহাসিক বাস্তবতা হচ্ছে আওয়ামী লীগ নেতানির্ভর নয়, কর্মীসমর্থকভিত্তিক দল। সুদিনে এদের বেশিরভাগ ঘুমে থাকে, দুর্দিনে ওঠে জেগে।
আওয়ামী লীগকে রুখতে তাই সরকার ও সরকারঘনিষ্ঠদের জবরদস্তির পথ পরিহার করে, সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। নেতা নাই, তবু কর্মীসমর্থকদের কেউ অনিরাপদ নয়–এই আস্থা না ফেরালে আওয়ামী লীগের ফেরা কেবল সময়ের অপেক্ষা।
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের একুশ বছর পর ক্ষমতায় গিয়েছিল আওয়ামী লীগ। সুতরাং লড়াইই কেবল নয়, অপেক্ষাও এই দলটির মজ্জাগত।
তাই অপরিপক্ব চিন্তার জবরদস্তি দিয়ে নয়, সহাবস্থান দিয়ে নিশ্চিত করতে হবে ‘নয়া রাজনৈতিক বন্দোবস্ত’। এছাড়া আর উপায় দেখি না।
লেখক, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।