সুব্রত বিশ্বাস
বাংলাদেশে গণমাধ্যমের অতীত অবস্থার সমালোচনা করে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনুস বলেছিলেন, এখন আপনারা প্রাণ খুলে, মন খুলে ইচ্ছে মতো কথা বলতে পারেন এবং পারবেন। অথচ বাস্তবতা হলো, গণমাধ্যম এখন যে গভীর সংকটে পড়েছে এতে কোন সন্দেহের অবকাশ রাখেনা। বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, ইতিমধ্যে বহু গণমাধ্যম বেদখল হয়ে গেছে। বহু গণমাধ্যমের সাংবাদিক চাকুরিচ্যুৎ হয়েছেন। বহু সংবাদমাধ্যমের মাথায় জোর করে নিজেদের মব গ্যাং অথবা সরকারের তল্পীবাহক বসিয়ে দেওয়া হয়েছে।
যেসব সাংবাদিককে মনে করা হয়েছে গত সরকারের পক্ষে কাজ করেছেন তাদের অনেককে জেলে যেতে হয়েছে, অনেককে খুনের মামলার আসামী করা হয়েছে। দেশ থেকে ভারত হয়ে পালিয়ে নিউইয়র্কে আসা পূর্ব পরিচিত এক সাংবাদিক বন্ধুর সাথে দেখা। তার বিরুদ্ধে তিনটি খুনের মামলা, অথচ দীর্ঘদিন থেকে তাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি-জানি একজন সৎ ও ভালো মানুষ। জীবনের হুমকি নিয়ে চরম চাপের মুখে সাংবাদিক এবং সংবাদ মাধ্যম।
অনেকে বলছেন, অতীতের বিএনপি, জাতীয় পার্টি এমনকি শেখ হাসিনার সরকারের সময় সংবাদমাধ্য ও সাংবাদিকদের অবস্থা এমনটি ছিল না। বস্তুত এখন সংবাদমাধ্যমের এক অন্ধকার যুগ চলছে। নাবালক সমন্বয়কদের কেউ কেউ (হাসনাত আলম) সংবাদ অফিসে গিয়ে তালিকা ধরিয়ে দিয়ে বলছেন এদের চাকুরিচ্যুত করতে হবে। কোন কোন সাংবাদিক সরকারের পক্ষ হয়ে গিয়ে হুমকি ধমকি দিচ্ছেন। তার চেয়ে বড় কথা গণমাধ্যমে যেসব খবর আসছে, গণমাধ্য কি সেসব খবর ছাপাতে পারছে না। অনেকে বলছেন, গণমাধ্যমে তো কোন খবর আসছে না, আসলে প্রকাশ হচ্ছে না বা প্রকাশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। সবশেষে যে ঘটনা ঘটলো ৩৩ বছরের পুরনো সংবাদ দৈনিক ভোরের কাগজ বন্ধ করেই দেওয়া হয়েছে। তাদের নোটিশের ভাষা ও ধরণ দেখে অনেকে মনে করছেন, কেউ হয়তো জবরদখল করতে যাচ্ছেন।
মালিক পক্ষ চান না তাদের পত্রিকা বেদখল হোক, তাই কোন কোন ক্ষেত্রে নিজেরা নাকি বন্ধ রেখেছেন এমন মিথ্যা গুজবি কথাও শোনা যাচ্ছে। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, ভোরের কাগজ কি আসলে হুমকিতে বন্ধ হয়েছে? অনেকে বলছেন, বাংলাদেশে অনেক পত্রিকা অনেক সাংবাদিক আছেন, তাদের মধ্যে প্রগতিশীল সাংবাদিক ও পত্রিকা বলে ভোরের কাগজকে সুতিকাগার হিসেবে দেখা হয়। শত দৈনতা সত্বে তারা পত্রিকা বন্ধ করেননি, অনেকে বেতন পেতেন না, কিন্তু কাজ করে স্বস্তি পেতেন। শ্যামল দত্ত ছিলেন তেমন পত্রিকাটির সম্পাদক। মিথ্যা খুনের মামলায় তিনি এখন জেলে আছেন।
দখল প্রবণতায় ইতিমধ্যে ৩/৪ টি পত্রিকা অফিসের খোলস পরিবর্তন হয়েছে, সম্পাদকের স্থলে নুতন পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, চরিত্র বদল হয়েছে পত্রিকার। বেশিরভাগ পত্রিকার মালিক প্রতিক্রিয়াশীল, তাদের চাপে পড়েও অনেক সাংবাদিকরা সংকটে পড়ছেন। অনেকে সাংবাদিক আবার মালিক পক্ষের দাবার খেলায় যোগ দেন। তার চেয়ে ক্ষতির কারণ চিঠি দিয়ে, সশরীরে গিয়ে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে, ফ্যাসিবাদী তকমা লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
প্রথম হুমকি এসেছে, যেসব সাংবাদিক পতিত সরকারের সাথে যুক্ত ছিলেন, তাদের হয়ে কাজ করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ তুলে ব্যবস্থ নেওয়া হবে জানানো হয়। এবং সবাইকে জবাবদিহির আওতায় আনা হবে। এই অভিযোগ তোলার পর পরই সাংবাদিক শফিক রেহমান ও জামায়াতের আমির ড. শফিকুর রহমান বৈঠকে বসেন। তারপর থেকে প্রতিহিংসামূলক পদক্ষেপ শুরু হয়।
সময় টিভি দৃঢ় অবস্থান না নিলে বন্ধ হয়ে যেত। ছাত্র সমন্বয়ক হাসান আব্দুল্লাহ ১০ জনের নাম ধরিয়ে দিয়ে বরখাস্তের হুমকি দেয়। সময় টিভি ১০ জনকে বরখাস্ত না করে ৫ জনকে বরখাস্ত করে অবস্থা সামাল দেয়। এভাবে টিভি ও সংবাদ মাধ্যমের উপর চাপ প্রয়োগ শুরু হয়। তারপর একসঙ্গে চলে সম্পাদক, বার্তা সম্পাদক এবং সাংবাদিক ছাটাই এবং সরকারের পছন্দের লোকদের বসানো। যুগান্তরের সম্পাককে সরিয়ে সেখানে আনা বসানো হয় আব্দুল হাই সরকারকে। সমকালের সম্পাদককে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে এখনও কাউকে বসানো হয়নি। মালিক পক্ষ চান না তাদের পত্রিকা বন্ধ হোক, তাই অনেক ক্ষেত্রে কেউ কেউ বন্ধ রেখেছেন। সরিয়ে দেওয়া হয়েছে তৌফিক মারুফ, মঞ্জুরুল হককে, বসানো হয়েছে ড. আব্দুর রাজ্জাককে। এখন মালিক চালাচ্ছেন ভারপ্রাপ্ত হিসেবে। সরকার পক্ষের অনুমতি ব্যতিরেকে সংবাদ ছাপানো সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যম চরম হুমকির মধ্যে আছেন। অনেকে বলছেন, অতীতের সকল বিধিনিষেধ তুলনা করলে সংবাদমাধ্যমের জগতে এখন এক ’বেøক চ্যাপ্টার যুগ’ চলছে।
লেখক: যুক্তরাষ্ট্র্র প্রবাসী রাজনৈতিক বিশ্লেষক।