ইতিহাস: প্রেম, পুরাণ, পৌত্তলিক রীতি ও সংস্কারের মিশেল
এস এ সবুজ
কালের অতল গহ্বরে, যখন রোম ছিল দেবতা ও রাজাদের নগরী, তখনই জন্ম নিয়েছিল এক অদ্ভুত উৎসব— লুপারকালিয়া। প্রতি বছর ১৩ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি, রোমান তরুণেরা ছুটে বেরোত নগরের পথে, হাতে থাকত বলিদান দেওয়া ছাগলের চামড়া। সেই চামড়া দিয়ে তারা ছুঁয়ে দিত নারীদের, বিশ্বাস করত— এ ছোঁয়া নারীর গর্ভকে করবে উর্বর, মাতৃত্ব দেবে আশীর্বাদের ছোঁয়া।
লাল রঙে রাঙানো ছিল এই উৎসবের প্রতীক।
লাল মানে রক্ত— প্রাণের প্রতিশ্রুতি, উর্বরতার অগ্নিশিখা, বন্য উন্মাদনার রং। দেবতা লুপারকাস বা ফাউনাস, যিনি ছিলেন প্রকৃতির রক্ষক, তিনিই ছিলেন এই উৎসবের কেন্দ্রে। বলিদানের ছাগল ও কুকুরের রক্ত দিয়ে আঁকা হতো তরুণদের কপাল, আর নগরী বয়ে যেত বাঁধভাঙা উল্লাসে।
কিন্তু এই উৎসবের পেছনে ছিল এক সুপ্ত ছন্দ, যা কালের স্রোতে এক নতুন রূপ নিতে যাচ্ছিল।
ভ্যালেন্টাইনের শহীদত্ব: প্রেমের জন্য প্রাণদান
রোম যখন শাসিত হচ্ছিল সম্রাট ক্লডিয়াস II-এর কঠোর শাসনে, তখন প্রেমের মন্দিরে জমছিল কালো মেঘ। তিনি ঘোষণা দিলেন— যুবকেরা যদি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়, তবে তারা যুদ্ধে দুর্বল হয়ে পড়বে। তাই ভালোবাসার শপথ, মিলনের প্রতিশ্রুতি সবই হয়ে গেল নিষিদ্ধ।
কিন্তু এক ব্যক্তি এ আদেশ মানতে নারাজ। তিনি ছিলেন ভ্যালেন্টাইন, এক খ্রিস্টান পুরোহিত। প্রেমের শপথের সামনে শাসকের নিষেধাজ্ঞা তাঁর কাছে ছিল তুচ্ছ। তিনি গোপনে বিবাহ দিতেন প্রেমিকযুগলকে, প্রেমের পবিত্র বন্ধনে বাঁধতেন তাদের।
কিন্তু সত্য চিরকাল গোপন থাকে না। ভ্যালেন্টাইন বন্দি হলেন, শাস্তি হলো মৃত্যু।
২৬৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি, ভালোবাসার সেই যাজক রক্ত দিয়ে লিখলেন প্রেমের শেষ কবিতা।
একটি কিংবদন্তি বলে, মৃত্যুর আগে তিনি তাঁর প্রিয়াকে লিখেছিলেন এক চিঠি, যার শেষে ছিল— “তোমার ভ্যালেন্টাইন”।
পৌরাণিক উৎসব থেকে খ্রিস্টীয় পবিত্রতায়
কিন্তু ভালোবাসার শপথ কি কখনো হারিয়ে যায়?
সময় এগিয়ে এলো ৪৯৬ খ্রিস্টাব্দ।
পোপ গেলাসিয়াস I ঘোষণা দিলেন— “লুপারকালিয়া পাপাচার, অনৈতিক। একে বিলুপ্ত করতে হবে!”
তিনি স্থাপন করলেন ১৪ ফেব্রুয়ারিকে সেন্ট ভ্যালেন্টাইন দিবস হিসেবে, যেন ভালোবাসার নামে উৎসর্গিত হয় এই দিন, কিন্তু উন্মত্ততার নামে নয়।
তবে কি রোমানদের রক্তাক্ত উৎসব মুছে গেল?
না, মুছে গেল না, বরং রূপ নিল প্রেমের এক নতুন কাব্যে।
মধ্যযুগ ও প্রেমের কবিতা
সময় গড়ালো, ইতিহাস লিখল নতুন অধ্যায়।
১৪শ শতকের কবি জিওফ্রে চসার তাঁর কাব্যে বললেন—
“১৪ ফেব্রুয়ারি, এই দিনে পাখিরা জোড়া বাঁধে, হৃদয়ে প্রেম জাগে।”
এভাবেই সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের নাম হয়ে গেল প্রেমের কবিতার প্রতিচ্ছবি।
শুভেচ্ছা বিনিময়ের রীতি শুরু হলো, ভালোবাসার মানুষকে লেখা হলো প্রথম “ভ্যালেন্টাইন কার্ড”।
বাণিজ্যের ছোঁয়া: প্রেম কি শুধুই ভালোবাসা?
প্রেম কি শুধুই হৃদয়ের বিষয়, নাকি এতে বাণিজ্যের গন্ধ লেগেছে?
১৮শ-১৯শ শতকে, হাতে লেখা ভালোবাসার চিঠির জায়গা নিল ছাপানো কার্ড।
২০শ শতকে, ভালোবাসার প্রতীক হয়ে উঠল চকোলেট, গোলাপ, হীরার আংটি।
“হলমার্ক” কোম্পানি শুরু করল বাণিজ্যের নতুন খেলা— “ভালোবাসা প্রকাশ করতে চাইলে উপহার দাও!”
এখন?
ভ্যালেন্টাইনস ডে মানে বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি গোলাপ বিক্রি, চকোলেটের পাহাড়, দামি উপহার আর বিলাসবহুল রেস্তোরাঁয় রাতের খাবার।
সংস্কারের রাজনীতি: কেন খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করল পৌরাণিক উৎসব?
খ্রিস্টধর্ম কি কেবল ভালোবাসার জন্যই এই দিনকে গ্রহণ করেছিল?
না, এর পেছনে ছিল রাজনৈতিক চাল খাটিয়ে মানুষকে বোকা বানিয়ে অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য সাধন। রোমান সাম্রাজ্য ছিল বহু সংস্কৃতির মিশ্রণ, যেখানে বহু দেবতা, বহু উৎসব। যদি এই উৎসবগুলো নিষিদ্ধ করা হতো, তবে বিদ্রোহ বাঁধতে পারত।
তাই খ্রিস্টধর্ম এক চতুর পন্থা নিল— পুরোনো উৎসবগুলোর রূপ বদলে তাদের খ্রিস্টীয় রঙে রাঙিয়ে দিল।
ঠিক যেমন—
সাতুরনালিয়া থেকে হলো ক্রিসমাস,
সামহেইন থেকে হলো হ্যালোইন,
লুপারকালিয়া থেকে হলো ভ্যালেন্টাইনস ডে।
শেষ কথা: প্রেম, ইতিহাস ও পরিবর্তনের কাব্য
ভ্যালেন্টাইনস ডে কি কেবল প্রেমের? নাকি এর মাঝে মিশে আছে ইতিহাস, ধর্ম, রাজনীতি ও বাণিজ্যের সূক্ষ্ম খেলা?
প্রেম কি শুধুই হৃদয়ের, নাকি এটি এক বহুমাত্রিক রঙিন ছায়া, যেখানে একদিকে ভ্যালেন্টাইনের আত্মত্যাগ, অন্যদিকে বাণিজ্যের হাতছানি?
যাই হোক, যুগে যুগে ভালোবাসা নতুন রূপ নেয়, নতুন ভাষায় কবিতা লেখে।।
ভালোবাসা দিবসের ইতিহাসে প্রাচীন রোমের লুপারকালিয়া উৎসব থেকে শুরু করে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের আত্মত্যাগ, সবই মিশে আছে।
লুপারকালিয়া ছিল রোমের এক প্রাচীন উর্বরতা উৎসব, যা ১৫ ফেব্রুয়ারি পালিত হতো। এই উৎসবে পুরোহিতরা পশু বলি দিয়ে তাদের চামড়া দিয়ে নারীদের স্পর্শ করতেন, যা উর্বরতার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হতো। লাল রঙ, যা রক্ত ও উর্বরতার প্রতীক, এই উৎসবে বিশেষ গুরুত্ব পেত।
তবে খ্রিস্টধর্মের প্রসারের সাথে সাথে এই পৌত্তলিক রীতির পরিবর্তন ঘটে। ২৬৯ খ্রিস্টাব্দে সেন্ট ভ্যালেন্টাইন নামের এক খ্রিস্টান পাদ্রী রোম সম্রাট ক্লডিয়াসের আদেশ অমান্য করে গোপনে বিবাহ সম্পন্ন করতেন। ফলস্বরূপ, তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় ১৪ ফেব্রুয়ারি। তার এই আত্মত্যাগের স্মরণে পোপ জেলাসিয়াস ৪৯৬ খ্রিস্টাব্দে ১৪ ফেব্রুয়ারিকে সেন্ট ভ্যালেন্টাইন দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন।
মধ্যযুগে কবি জিওফ্রে চসারের লেখায় ১৪ ফেব্রুয়ারি প্রেমের দিন হিসেবে উল্লেখ পাওয়া যায়, যা এই দিবসকে প্রেমের সাথে আরও গভীরভাবে যুক্ত করে। পরবর্তীতে, ১৯শ শতাব্দীতে বাণিজ্যিকীকরণের ফলে কার্ড, ফুল, চকলেট ইত্যাদি উপহার দেওয়ার প্রচলন শুরু হয়, যা আজকের ভ্যালেন্টাইনস ডে উদযাপনের রূপ নিয়েছে।