সুজিত কুমার দত্ত
বিশ্বভারতীর প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের তদানীন্তন অধিকর্তা অধ্যাপক ডঃ সুধাকর চট্টোপাধ্যায়কে একদিন ডেকে সৈয়দ মুজতবা আলী কিছুটা উপদেশের সুরে বললেন– ভাই, দ্যাখ, প্রাচীন ভারতের ইতিহাস নিয়ে কাজ করিস মহাভারতটা খুব ভালো করে পড়বি। আর নীলকণ্ঠের টীকাটাও পড়িস।
পৃথিবীর বহু দেশে থেকেছেন তবে কলকাতার প্রতি হৃদয়ের টান অনুভব করতেন। খুব বই পড়তে ভালোবাসতেন, তাই দ্বিধা না রেখেই মুজতবা আলী বলতেন যে শহরে কলকাতার মতো পাবলিক লাইব্রেরী নেই, সেই শহরে উনি কোনও অবস্থাতেই থাকতে পারবেন না। সৈয়দ মুজতবা আলী সাহিত্য অ্যাকাডেমি পাননি, রবীন্দ্র পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য মনে হয়নি সংকীর্ণমনা বিচারকদের। কিন্তু তিনি বাঙালি পাঠকের অবিশ্বাস্য ভালোবাসা পেয়েছেন। বাংলা সাহিত্যে তাঁর স্থান কুতুবমিনারের মত তুলনাহীন। তিনি বাঙালির মনের বদ্ধ ঘরে মুক্ত বাতাস এনেছেন, দেশ- বিদেশের হাওয়া ঢুকিয়েছেন। নিরপেক্ষভাবে মূল্যায়ন করতে হলে বলতে হয় সৈয়দ মুজতবা আলীর সাথে তুলনীয় লেখক বাংলা সাহিত্যে আগেও নেই, পরেও নেই।
কম-বেশি পঁচিশটা ভাষা জানতেন। কিন্তু প্রখর রসবোধসম্পন্ন মানুষ। যদিও কন্দর্পকান্তি, কিন্তু সেখানেও নিজেকে নিয়ে রসিকতা করতে ছাড়লেন না। একটি লেখায় নিজের বর্ণনা দিয়েছিলেন, অত্যন্ত রোগা, সিড়িঙ্গে, গায়ের রং ছাতার কাপড়কেও লজ্জা দেবে এবং তোতলা। কথা বলার সময় মুখ দিয়ে থুতু ছোটে।
সৈয়দ মুজতবা আলী বলতেন- “মুখের কথার দাম আমার কাছে দলিল সইয়ের থেকে কম নয়”। মুখের কথা রাখতে গিয়ে অনেক সময় তিনি ক্ষতিগ্ৰস্ত হয়েছেন, কিন্তু নিজের জবান কখনও খেলাপ করেন নি। রবীন্দ্রনাথকে সৈয়দ মুজতবা আলী কথা দিয়েছিলেন ‘বিশ্বভারতীর সেবার জন্য যদি আমাকে প্রয়োজন হয় তবে ডাকলেই আমি আসবো। যা দেবেন হাত পেতে নেবো’ -তিনি কথা রেখেছিলেন।
শিবরাম চক্রবর্তীর লেখার সাথে মুজতবা পরিচিত শুধু হলেন, না মুগ্ধ হলেন। মনে মনে ইচ্ছা, চমৎকার লেখা, যদি লেখকের সাথে আলাপ হয় মন্দ হয় না। কিন্তু শিবরাম শুধু লেখেন, অন্যদের লেখাও বিশেষ পড়তেন না। তবে সৈয়দ মুজতবা আলীর দেশে বিদেশে, চাচা কাহিনী, পঞ্চতন্ত্র ইত্যাদি পড়ে ফেলেছিলেন। একদিন
বসুমতী অফিসে, প্রাণতোষ ঘটকের আড্ডায় সৈয়দ মুজতবা আলীর সাথে শিবরাম চক্রবর্তী মহাশয়ের পরিচয়টা হয়েই গেলো। প্রাথমিক আলাপচারিতার পর মুজতবা আলী পরম আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার অফুরন্ত এতো গল্প আপনি পান কোত্থেকে? নিশ্চয়ই আপনার গ্রন্থসংগ্রহটি খুব বিরাট হবে, দেখতে ইচ্ছা করে। কি করে দেখবেন? একখান বইও নেই আমার। এমনকি আমার নিজের বইও না।
সেদিন বাইরে অকাল বর্ষণ শুরু হয়েছে, থামার আর কোনও লক্ষণ নেই। অনুজপ্রতিম সাহিত্যিক কে সৈয়দ মুজতবা আলী বললেন- “বৃষ্টিতে ভিজে লাভ নেই। তোমাকে আমার ছাতিটা লোন দিচ্ছি- কিন্তু সাবধান মেরে দিও না যেন”! স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে অনুজপ্রতিম সাহিত্যিক বললেন আপনার কলম যখন চুরি করতে পারলাম না তখন এই ছাতি মেরে আমার কি হবে!
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ কবিতা এবং ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ প্রবন্ধ মুজতবা আলীর মুখস্থ ছিল। মৃত্যুর কিছুদিন আগে শেষ যেবার সাহিত্যিক শংকরের সাথে তাঁর দেখা হয় হঠাৎ তাঁর হাত চেপে ধরে বললেন- তুমি একবারটি সঞ্চয়িতাখানা ধরো তো। বললেন- ওমুক পাতা খোলো তো। খুললেন, “কর্ণকুন্তি সংবাদ ওই পাতার রয়েছে তো জানতে চাইলেন। তারপর আবৃত্তি শুরু করলেন। একবারও থামলেন না, একটা বার কোথাও ভুল হলো না। স্নেহভাজন এক বন্ধুর মায়ের শ্রাদ্ধে উপস্থিত হয়েছিলেন। বললেন- “গীতাটা আমি পড়ে দিই”। তারপর একবারেও বইয়ের দিকে না তাকিয়ে আদ্যন্ত গীতা আবৃত্তি করলেন।
১১ ফেব্রুয়ারি তাঁর প্রয়াণ দিবস। তবে বেদনার দিক আছে। মুজতবা আলীর উদারতাকে সমালোচনা করে কুৎসাকারীরা বলেছেন- ওটা আই ওয়াশ, আসলে তিনি পাকিস্থানী এজেন্ট। ছিঃ ছিঃ এমন উদার মানুষের বিরুদ্ধে এহেন ঘৃন্য কুৎসা। তীব্র প্রতিবাদ হওয়া উচিত ছিল। সেদিন কতো প্রতিবাদ হয়েছিল আমাদের অজানা। আজও প্রতিবাদ করা যায় দৃঢ়কণ্ঠে বলা যায় মানুষ মুজতবা আলীরা আমাদের আশেপাশে খুব বেশি নেই।
পুস্তক ঋণ ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার : চরণ ছুঁয়ে যাই, শংকর
শান্তিনিকেতনের স্মৃতি, সুধাকর চট্টোপাধ্যায়,
কুহেলী চক্রবর্তীর নিবন্ধ আনন্দবাজার পত্রিকা।