।। সাগুফতা শারমীন ।।

একদিন আগে গেছি রক্তপরীক্ষা করতে। সঙ্গে কুশান। সে তো আজকাল আর আমার উপগ্রহ নয়, সে ধুমকেতুর মতো আসে আবার দীর্ঘদিনের জন্য ফিরে যায়। যেহেতু তার সঙ্গ চেয়েও পাওয়া যায় না, আমি ভাবি- আঙুরফল ও কুশান টক। ভাবি- ওকে আমার কীসের দরকার, কি এমন আনন্দ সে আমায় দেয় যে তাকে আমার লাগবেই! এভাবে আমি বহু কি-এমন-রসগোল্লার সঙ্গ থেকে মনকে ঘুরিয়ে আনতে পেরেছি, কুশানই বা বাদ যাবে কেন!
ডাক এলো, গেলাম, ছুঁচ ফুটিয়ে মেরুন রক্ত নিল হেতাল নাম্নী এক ফ্ল্যাবোটমিস্ট, আমার বেহুদা কথা বলার স্বভাব, তাকে বলে এলাম- “তোমার নামে সুন্দরবনে গাছ আছে!”
বের হয়ে এসে দেখি একজনমাত্র বুড়োমতন লোক ঝিমোচ্ছে, কুশানকে বললাম, “কুশু, মি ডান!” (টারজান-ইংলিশে আমরা কথা বলতাম একসময়)
কুশানের মুখ কুঁচকে উঠে টানটান হয়ে গেল, যেন ওটা ওর নামই নয়!
বাইরে এসে শুরু হলো, মি ডান মানে কি? তুমি বলতে পারতে- মাই ওয়ার্ক ইজ ডান হিয়ার। বলতে পারতে- আই অ্যাম ডান। মি ডান কুশু!! কুউশুউউউ! হোয়াই!!
আমি কিছুক্ষণ সহ্য করলাম। তারপর স্বরূপে আবির্ভুত রাক্ষুসী হলাম, বল্লাম, “আমার বয়স আর দুই বছর পর পঞ্চাশ হবে। আমার মা আমাকে এখনো বাগে পেলে আদর করে জড়িয়ে ধরে ডাকে ‘ছুজি-বাচ্চা’!”
-ছুজি-বাচ্চা মানে কি?
-মানে সেমোলিনা স্লারি খাওয়া দন্তহীন ন্যাদা বাচ্চা!
কুশান ভ্যাকভ্যাক করে হাসতে শুরু করলো। বললাম, “আরো আছে। এয়ারপোর্টে শেষবার যখন এসেছে তখনো আমার মা-বাবা আমাকে বলেছে- ঠিকমতো টয়লেটে যেও, প্রতিদিন অনেক পানি খেও, কাপড়চোপড়-অন্তর্বাস সব প্রতিদিন পাল্টাতে ভুলো না।… এয়ারপোর্টের পথিক শুনলে মনে করবে, এরা দুজন পথের পাগলীকে এদ্দিন বড় করেছে! আর তুমি একটা ‘মি ডান কুশু’ সইতে পারছ না?”
বলতে বলতে আমি নিজেই হাসছি।
আম্মার কান্ড, কি আর বলবো! ঘুম থেকে বাংলাদেশের সকালে জেগে উঠে কতবার দেখেছি আম্মা আমার হাত পায়ের আঙুলগুলো ধরে ধরে চশমাচোখে পরখ করছে- পরিষ্কার আছে কি না, ক্ষত আছে কিনা, হাতগুলো আর নরম নেই কেন। আমাদের অনেকদিনের ডেরা ছিল গাওছিয়া মার্কেটের ভেতরের একটা দোকান- চটপটি আর ফুচকা খেতাম দুজন, তারপর সামনের দিকের দোকানের মোটা মোটা জিলাপি (সরু জিলাপির তখনো চল হয়নি, চল হবার পরেও আমার কখনো ভালো লাগেনি), আম্মা দেখে দেখে কিনতো রুবিয়া জর্জেট আর ভয়েল কাপড়। একবার বাংলাদেশে গিয়ে ভাবলাম আম্মার সঙ্গে সেইসব পুরনো কাজ করি, করলাম। ওয়ারেস ব্রিজের তলায় দাঁড়িয়ে আমরা জিলাপি খেলাম, আম্মা হাতের পাতলা টিস্যু দিয়ে আমার মুখ মুছিয়ে দিল আর পানির বোতল দিয়ে আলগোছে পানি খাইয়ে দিল…হায় পক্ষীশাবকের প্রতিবর্তী ক্রিয়ার মতো আমিও ওসব হতে দিলাম। “এইজ ইজ আ নাম্বার”–বাক্যটি অসম্পুর্ণ, “এইজ ইজ আ নাম্বার রেগুলারলি টুইকড বাই ইওর পেরেন্টস।” বয়স আসলে আপনার মাতাপিতার হাতে অ্যাবাকাসের গুল্লি- ইচ্ছেমতো এলোমেলো করে দেবে।
ওসব ভাবতে ভাবতে একবার রসগোল্লার দিকে তাকালাম, দেখি এলোমেলো দু-তিনটে দাড়ি আর নীল গোঁফের রেখার পরেও তার প্রোফাইলে সেই গোল গালটুকু উপস্থিত। এ গালে নাক ঠেকিয়ে কত আদরই না করেছি, তা এখন করতে দোষ কি! রাস্তা পার হতে যাচ্ছিল, থামালাম, থামিয়ে আচ্ছামতো আদর করলাম। আমার ইচ্ছা! সেও সহ্য করলো।
গতকাল এক বসায় আমি প্রায় সাড়ে চার হাজার শব্দ লিখেছি, আজ তাই মন ফুরফুরে। সকালে বসে বসে কুশানকে একুশের ইতিহাস বললাম। একুশ থেকে একাত্তর। সে শুনলো। বলতে বলতে হঠাৎ মন মুচড়ে উঠলো, মনে হলো, বাংলা ভাষাটাকে আমি একটি মানুষের মতো ভালোবাসি, যেন সে আত্মীয়, মা, সন্তান, প্রিয়জন, অযথা আলিঙ্গনের একান্ত দাবীদার।
লেখক: কথা সাহিত্যিক, বিলাতবাসী।