জুলাই ষড়যন্ত্র এবং ‘কোটা’ নিয়ে প্রতারণা। জুলাই ষড়যন্ত্রে আহত, নিহতের সন্তানেরা ভর্তিতে পাবেন কোটা সুবিধা।
সরকারের এই সিদ্ধান্ত সরাসরি প্রতারণা ও দ্বিচারিতার প্রতিচ্ছবি। ক্ষমতায় আসার আগে যারা কোটা সংস্কারের নামে আন্দোলন চালিয়েছে, তারা এখন নিজেদের স্বার্থে নতুন কোটা তৈরি করছে—এটা রাজনৈতিক সুবিধাবাদের জঘন্য উদাহরণ। মুক্তিযুদ্ধ ছিল জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম, আর জুলাই ষড়যন্ত্র ছিল একটি রাজনৈতিক সরকার পরিবর্তনের নীলনকশা। এই দুইকে এক পাল্লায় মাপার চেষ্টা ইতিহাস বিকৃতির সামিল।
এই সিদ্ধান্ত শিক্ষার মেধাভিত্তিক প্রতিযোগিতাকে ধ্বংস করবে, কোটা সংস্কার আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্যকে পদদলিত করছে এবং ভবিষ্যতে যেকোনো আন্দোলনের শহীদ বা আহতদের নামে নতুন নতুন কোটার পথ খুলে দেবে। এটা স্পষ্টতই একটি রাজনৈতিক পক্ষপাতমূলক সিদ্ধান্ত, যেখানে ক্ষমতাসীন দল নিজেদের সমর্থকদের পুরস্কৃত করতে শিক্ষাব্যবস্থাকে কলুষিত করছে।
এভাবে চলতে থাকলে একসময় শিক্ষাক্ষেত্রে মেধার মূল্য থাকবে না, থাকবে শুধু রাজনৈতিক আনুগত্য। যারা একসময় ‘কোটা সংস্কারের’ পক্ষে দাঁড়িয়েছিল, তারা আজ মিথ্যাচারের চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত স্থাপন করলো। এটা শুধুমাত্র একটি ভুল নীতি নয়, এটি শিক্ষার শত্রুতা, মেধার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা এবং রাষ্ট্রীয় স্বার্থের সঙ্গে প্রতারণা।
১. নীতিগত কারণ
নীতিগতভাবে, কোটা ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সামাজিক ও ঐতিহাসিক অন্যায়ের শিকার বা বঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নেওয়া। মুক্তিযোদ্ধা কোটা সেই ভিত্তিতেই চালু হয়েছিল, কারণ মুক্তিযোদ্ধারা দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়েছেন এবং তাদের অনেকেই জীবনের মূল সময়টুকু হারিয়েছেন। কিন্তু জুলাই ষড়যন্ত্রে নিহত ও আহতদের ক্ষেত্রে এটি কতটা যৌক্তিক?
মুক্তিযুদ্ধ ও সাম্প্রতিক আন্দোলনের পার্থক্য-
মুক্তিযুদ্ধ একটি জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম ছিল, যেখানে দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু জুলাই ষড়যন্ত্র একটি রাজনৈতিক কূটকৌশল ছিল, যার ফলে সরকার পরিবর্তন হয়েছে।
এখানে প্রশ্ন ওঠে—
সরকার পরিবর্তনের ষড়যন্ত্রে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য কোটা সংরক্ষণ কতটা ন্যায়সংগত?
যদি এটি গ্রহণযোগ্য হয়, তাহলে ভবিষ্যতে যে কোনো আন্দোলনে নিহত বা আহত ব্যক্তিদের জন্যও কি কোটা চালু করতে হবে?
এভাবে কি কোটার সীমা ক্রমেই বিস্তৃত হতে থাকবে?
কোটা বনাম মেধা
সরকারি বিদ্যালয়ে ভর্তি একটি প্রতিযোগিতামূলক ব্যবস্থা। যখন একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক আসন সংরক্ষিত থাকে, তখন মেধাবীদের জন্য প্রতিযোগিতার সুযোগ কমে যায়। কোটা যদি ক্রমাগত বৃদ্ধি পায়, তবে এটি মেধাবীদের প্রতি অবিচার হতে পারে।
২. সামাজিক কারণ
একটি গণতান্ত্রিক সমাজে সব নাগরিকের সমান সুযোগ থাকা উচিত। কোটাব্যবস্থা সাধারণত বঞ্চিত ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জন্য সংরক্ষিত থাকে। প্রশ্ন হলো—
জুলাই ষড়যন্ত্রে আহত বা শহীদদের পরিবার কি সেই ধরনের সামাজিক বৈষম্যের শিকার?
মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেওয়ায় আর্থ-সামাজিক দিক থেকে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন।
কিন্তু জুলাই ষড়যন্ত্রে অংশ নেওয়া ব্যক্তিরা মূলত রাজনৈতিক কূটকৌশলে জড়িত ছিলেন, যা একটি রাষ্ট্রীয় নীতির বিরোধিতা ছিল, মুক্তিযুদ্ধের মতো জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম নয়।
আগামীতে নতুন নতুন কোটা যুক্ত হলে সামগ্রিক সমাজ কীভাবে প্রভাবিত হবে?
যদি প্রতিটি সরকার তার পক্ষের আন্দোলনে নিহত ও আহতদের জন্য কোটা সংরক্ষণ করে, তাহলে ভবিষ্যতে শিক্ষাক্ষেত্রে মেধার ভিত্তিতে প্রতিযোগিতা ক্রমেই সংকুচিত হয়ে পড়বে।
এটি একটি বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত তৈরি করতে পারে, যেখানে রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় এসে নিজেদের সমর্থকদের জন্য সুবিধা সংরক্ষণ করবে।
৩. রাজনৈতিক কারণ
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় কোটা সংস্কার আন্দোলন হয়েছিল, যেখানে দাবি ছিল মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ ও ভর্তি নিশ্চিত করা। আন্দোলনের ফলে তখন কোটা ব্যবস্থায় কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছিল। কিন্তু, বর্তমান সরকার যেটি কোটা সংস্কার আন্দোলনের মিথ্যা অযুহাতে ক্ষমতায় এসেছে, তা সম্পূর্ণ উল্টো পথে হেঁটেছে এবং নতুন ‘কোটা’ সংযুক্ত করেছে। এটি এক ধরনের রাজনৈতিক দ্বিচারিতা। জাতির সাথে প্রতারণা।
রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সিদ্ধান্ত?
সরকার যদি মনে করে, জুলাই ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণকারীরা তাদের শক্তিশালী সমর্থকগোষ্ঠী, তাহলে এই কোটার মাধ্যমে তাদের রাজনৈতিকভাবে পুরস্কৃত করা হচ্ছে।
এটি রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের একটি জঘন্য দৃষ্টান্ত, যেখানে ভবিষ্যতেও ক্ষমতাসীন সরকার নিজেদের সমর্থকদের বিশেষ সুবিধা দেবে।
যারা কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন, তারা সরকারের এই সিদ্ধান্তে প্রতারণার শিকার হয়েছেন বলে মনে করতে পারেন। কারণ, কোটা বাতিলের দাবি নিয়ে আসা দল এখন নিজেই নতুন কোটা সংযোজন করেছে। এটি জনগণের মধ্যে সরকারের প্রতি বিশ্বাসের তীব্র সংকট সৃষ্টি করে।
৪. সম্ভাব্য ফলাফল ও ভবিষ্যৎ প্রভাব
এই সিদ্ধান্তের কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব হতে পারে—
শিক্ষাক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
মেধাবীদের জন্য প্রতিযোগিতার সুযোগ কমবে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রছাত্রীদের মানসিকভাবে বিভক্তির সৃষ্টি হতে পারে।
ভবিষ্যতে অন্যান্য আন্দোলনকারীরাও কোটা দাবি করতে পারেন
যদি জুলাই যড়যন্ত্রে অংশগ্রহণকারীদের জন্য কোটা সংরক্ষিত হয়, তাহলে ভবিষ্যতে বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশ নেওয়া ব্যক্তিরাও একই সুবিধার দাবি করতে পারেন।
এটি একটি অবাঞ্ছিত প্রবণতা সৃষ্টি করতে পারে, যেখানে রাজনীতি ও শিক্ষানীতি আরও ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে যাবে।
সরকারের প্রতি জনগণের আস্থার সংকট তৈরি করবে।
যারা কোটা সংস্কার আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলেন, তারা সরকারের এই সিদ্ধান্তকে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে দেখবেন।
এতে জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক হতাশা ও অসন্তোষ বৃদ্ধি পেতে পারে।
—উপসংহার
সরকারের এই সিদ্ধান্তকে একাধিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়—
ক. নীতিগতভাবে, এটি মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে তুলনীয় নয় এবং এটি শিক্ষাক্ষেত্রে মেধার সঙ্গে সংঘর্ষ সৃষ্টি করবে।
খ. সামাজিকভাবে, এটি নতুন একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার দৃষ্টান্ত তৈরি করছে।
গ. রাজনৈতিকভাবে, এটি বর্তমান অবৈধ সরকারের একটি কূটকৌশল, যা রাজনৈতিক সুবিধা নিশ্চিত করতে করা হয়েছে।
ঘ. ভবিষ্যৎ প্রভাব, এটি শিক্ষাক্ষেত্রে ও রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তথ্যসূত্র: ATeam
সাবস্ক্রাইব
সর্বশেষ খবরের সাথে আপডেট থাকুন।