।। মনজুরুল হক ।।
পায়ের তলাকার মাটি আলগা হলেও পুরোপুরি সরে যায়নি ড. ইউনূসের। তিনি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তার অপশনগুলো ব্যবহার করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চাইবেন। কীসের জোরে? জনসমর্থন যে নেই তা বলাবাহুল্য। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সরকারপ্রধানের কথাই শেষ কথা। এই ক্ষমতা বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টেরও নেই!
📍
একাধিক সূত্র মতে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি সেনাপ্রধান যে কড়া বক্তব্য রেখেছিলেন তার পেছনে ছিল মার্কিন চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স রাষ্ট্রদূত ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসন। গত পরশু যখন সেনাপ্রধানকে যমুনায় ডেকে কড়া ভাষায় সমালোচনা করে পদত্যাগ করতে বলা হয়েছিল তখনও এই ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসনের প্রসঙ্গ উঠেছিল। এখন প্রশ্ন হলো ড. ইউনূসকে গত সাত মাসের ব্যর্থতার পরও কে বা কারা শক্তি যোগাচ্ছে?
📍
তিনি হয়ত এখনও জর্জ সোরেসের সাহায্য পাচ্ছেন, তবে সেটা ভীষণ গোপনে। সেটা অপ্রতুল, তাই এবার ‘খাতির’ গড়তে চাচ্ছেন এলন মাক্সের সঙ্গে। তার স্টারলিংক ইন্টারনেট বাংলাদেশে চালু করার টোপ দিয়ে। মোটা দাগে এই হাই পেইড ইন্টারনেটের কোনও দরকার নেই দেশে। হয়ত ২/৩ শতাংশ গ্রাহকও নেবে না। সেটা আবার কো-অর্ডিনেট করবে গ্রামীণ ব্যাংক, গ্রামীণ ফোন! অর্থাৎ এখানেও মুহাম্মদ ইউনূসের ব্যবসা। এই ব্যাপারে ট্রাম্প-ইউনূসের সিমিলারিটি আছে। দুজনই ব্যবসাকে প্রাধান্য দেন।
‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে সরকারপ্রধানের কথাই শেষ কথা।‘ ধরে নিয়ে তিনি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত টিকে থাকতে যে প্ল্যানগুলো নিতে পারেনঃ
📍
প্ল্যান- A. ১৩ তারিখে যখন ডেনাল্ড ট্রাম্প-মোদী ঘনিষ্ঠ বৈঠক করছেন, সে সময় ড. ইউনূস স্টারলিংকের কানেকশন নিয়ে এলন মাস্কের সঙ্গে ভিডিও মিটিং করেছেন। যদিও এখনও অনুমোদন ও নীতিমালা চূড়ান্ত হয়নি। এর প্রাথমিক ডিভাইস খরচ: ৪৩ থেকে ৭৪ হাজার টাকা (স্টারলিংক কিট) মাসিক ফি: ন্যূনতম ১৫ হাজার টাকা। এটা উপলক্ষ্য মাত্র। আসলে তিনি মাস্কের মাধ্যমে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক ‘মিনিমাইজ’ করতে চাইছেন। এ ব্যাপারে লবিস্টও নিয়োগের খবরও ছড়িয়েছে।
📍
প্ল্যান- B. যদিও পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেছেন-’ট্রাম্পের ২৯ মিলিয়ন ডলারের খবর ভিত্তিহীন’। অবশ্য তিনি কোনো ডাটা কিংবা সূত্র দেখাতে পারেননি, আবার নিজেকে বিশ্বের সর্বোচ্চ শক্তিধর ভেবে ‘ট্রাম্পকে ক্ষমাও করে দিয়েছেন!’ শোনা যাচ্ছে খুব শিগগিরই ট্রাম্প ড. ইউনূসকে হোয়াইট হাউসে ডাকতে পারেন। উদ্দেশ কী হতে পারে অনুমেয়। তিনি হয়ত যুক্তরাষ্ট্রের লগ্নিকৃত অর্থ ফেরৎ চাইবেন। যদি ধরেও নেওয়া যায় ড. ইউনূস সব পরিশোধ করে দিলেন। তার পরও কি সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে? মাস্ক সুপারিশ করলেও হবে না কারণ, ট্রাম্পের দফতরে বাংলাদেশ সম্পর্কে যে রিপোর্ট তাতে ‘ড. ইউনূসের সরকার বাংলাদেশে র্যাডিক্যাল ইসলামিস্টদের মদদ দিয়ে তাদের জোরে টিকে আছেন এবং একটা নতুন ‘সিরিয়া সিচুয়েশন’ তৈরি হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ায়। যা ট্রাম্প প্রশাসন মেনে নেবে না।
📍
প্ল্যান- C. কয়েকদিন আগে ১১ সদস্যের একটা টেকনিক্যাল টিম পাঠিয়েছেন ভারতে। তারা তিস্তা প্রকল্পসহ আরও কিছু বিষয়ে নিয়ে কথা বলে সম্পর্ক জোড়া দিতে চেষ্টা করবেন। ৫ দিনের সফরের শুরুতেই ভারত ‘চিকেন নেক’ সংলগ্ন অঞ্চলে এই মুহূর্তে কোনও প্রজেক্টে রাজি নয়। স্ট্রেইট ‘না’ বলে দিয়েছে। অনির্বাচিত সরকাররের সঙ্গে যতটুকু না থাকলেই নয় ততটুকু ছাড়া সম্পর্ক রাখবে না।
📍
প্ল্যান- D. বর্তমান সেনাপ্রধানকে ‘পতিত ফ্যাসিবাদের’ প্রতি ‘সফট’ ট্যাগ দিয়ে তাকে সরিয়ে পছন্দের সেনাপ্রধান বসানোর চেষ্টা করবেন। ছাত্র প্রতিনিধিগণ এবং বিদেশে লিল্লাখোর কয়েকজনের উসকানিতে ইতোমধ্যেই সেনাপ্রধানকে হেয় প্রতিপন্ন করে বিদায় করার যোগাড়যন্ত্র চলছে। এ বিষয়ে দুদিন আগে যমুনাতে বেশ উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়েছে। স্বভাবতই ‘উত্তরপাড়া’য় চাঞ্চল্য বিরাজ করছে। কারা কাদের সঙ্গে মনস্তাত্ত্বিক লড়াই চালাচ্ছে সেটা আমাদের পক্ষে এই মুহূর্তে জানা সম্ভব নয়। তবে ভেতরে ভেতরে তোলপাড় চলছে সেটা অনুমান করা যাচ্ছে।
📍
প্ল্যান- E. প্রাক্তন বিডিআর বিদ্রোহ হত্যাকাণ্ডের বিচার বিষয়ে সেনাপ্রধানের স্ট্রেইট ফরওয়ার্ড মন্তব্য’র পরে হাতে রয়েছে নতুন গঠিত দল- ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’। এদের দিয়ে জাতীয় নির্বাচনের দাবিকে মাটিতে পুঁতে দিয়ে গণপরিষদ ও স্থানীয় নির্বাচনের বিষয়টি সামনে আনা হবে। যারা এই মুহূর্তে নির্বাচন চাইছে তাদেরকে ‘জাতির শত্রু’ আখ্যা দেওয়া হবে। ‘নির্বাচন আগে না রাষ্ট্র মেরামত আগে?’ এরকম ইস্যু নিয়ে নিওলিবারাল পরামর্শদাতারা ঘন ঘন সেমিনার করে বোঝাবে-‘আগে দেশ বাঁচাতে হবে, নির্বাচন নিয়ে বেশি মাতামাতি করলে দেশটা ‘গাজা’ হয়ে যাবে’। এইসব বয়ানের জন্য তাদের হাতে ডজন ডজন ‘লিল্লাহখোর’ বুদ্ধিব্যাপারি আছেন।
📍
এই সবগুলো অপশন বা প্ল্যান অন্তর্বর্তী সরকার ব্যবহার করবে। তাদের বিশ্বাস একটা না একটা দিয়ে শাসন দীর্ঘায়িত করা যাবে। যেটা তাদের আসল পরিকল্পনা। এরই মধ্যে প্রায় ৬ হাজার নতুন রোহিঙ্গা ঢুকতে দেওয়া হয়েছে। রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে এন্তার টাকা ঢেলে, পাকিস্তানের এডি সাপ্লাই দিয়ে ট্রেইনিং দেওয়া হবে। সাজেকে কি হুট করেই আগুন লেগেছে? ওখানে কি কিছু একটা হচ্ছে? উগ্র ইসলামিস্ট দলগুলোর স্লিপার সেল সক্রিয় হচ্ছে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমাদের জানা নেই। তার মানে এই নয় যে কেউ জানে না। পাকিস্তান হাজার মাইল উড়ে এসে এখানে এসপিওনাজ চালাবে আর ভারতের এজেন্সিগুলো জানবে না? তা কি করে হয়? সম্ভবত সে কারণেই বাংলাদেশের সীমান্তজুড়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী লজিস্টিক অ্যারেঞ্জমেন্ট বাড়িয়ে তুলেছে। বিশেষ করে ‘চিকেন নেক’ এবং ত্রিপুরা করিডোর সংলগ্ন অঞ্চলে ভারী আর্মস অ্যামুনিশন ডেপ্লয় করা হচ্ছে। ওড়িসার ল্যান্ড-টু-ল্যান্ড হাইপাসনিক মিসাইল ব্যাটারিও প্রস্তুত রেখেছে।
📍
এইসব অনুমানের ভেতর সবচেয়ে সিগনিফিকেন্ট হলো জামাতের নেতৃত্বে ইসলামিস্ট দলগুলো এখন চিৎকার-হুঙ্কার কমিয়ে গোপনে কাজ চালাচ্ছে। বিরাট সংখ্যক অ্যাটাকিং ফোর্স রেডি হচ্ছে।
📍
সামগ্রিকভাবে দেশে বড় ধরণের বিশৃঙ্খলা/খু.নো.খু.নির আশঙ্কা থেকে দুটো শক্তিশালী পরাশক্তি অন্তর্বর্তী সরকারকে পঞ্চদশ সংশোধনীর রদ আইন বলবত করে একটি ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ গঠন করে তাদের মাধ্যমে নির্বাচন দিতে বলেছে, এবং সে নির্বাচন হতে হবে ফুললি ইনক্লুসিভ, অর্থাৎ আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে হতে পারবে না। সরকার যদি ওই দুটি দেশের পরামর্শ অবজ্ঞা করে তাহলে দেশে অরাজকতা বেড়ে এমন অবস্থার সৃষ্টি হবে যা নির্বাচনের জন্য মোটেও উপযোগী নয়। তাহলে কী ঘটবে? বাংলাদেশে মার্চ মাসকে বলা হয়-‘অগ্নিঝরা মার্চ’। এবারকার মার্চ হয়ত একটু বেশিই ‘অগ্নিঝরা’ হয়ে উঠতে পারে। যার খেসারত দিতে হবে উলুখাগড়া, তথা সাধারণ মানুষকে।
📍
রাষ্ট্র ক্ষমতা এমনই এক বিধ্বংসী ক্ষমতা যা বয়লারের আগুনের মত মুহুর্মুহু বাড়তে থাকে। এই ক্ষমতার সীমাহীন লোভ বয়লারের মিটার চূড়ান্ত বাড়ানোর সময় মনে রাখতে পারে না-বয়লারের টেম্পারেচারের লিমিট আছে। সেটা ক্রস করলে বয়লার বিস্ফোরিত হয়। ৫ মার্চ ২০২৫
লেখক: সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক।